Advertisement
২০ জানুয়ারি ২০২৫
Coronavirus

এক মৃত্যুর আড়ালে অন্য মৃত্যু

মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক না কেন, তাতে বাস্তব বদলায় না। সেই বাস্তব হল, গঙ্গাম্মা বা রণবীর বাড়ি ফিরতে পারেননি।

সুজিষ্ণু মাহাতো
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২০ ০০:৪০
Share: Save:

চলে এসেছিলেন তিনশো কিলোমিটার। বাকি ছিল আরও দেড়শো কিমি। সেই পথ আর পেরোনো হয়নি গঙ্গাম্মার। কর্নাটকের বেঙ্গালুরু থেকে রাইচূড়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফেরার পথে বল্লারিতেই মারা যান বছর ঊনত্রিশের ওই মহিলা শ্রমিক। ক’দিন আগের ঘটনা।

গঙ্গাম্মার স্বামীও বেঙ্গালুরুতে শ্রমিকের কাজ করতেন। তিনি অবশ্য স্ত্রী-র আগেই ফিরেছিলেন। স্ত্রী’র মৃত্যুর পরে তিনি অভিযোগ করেন, দীর্ঘ পথ হেঁটে ফিরতে গিয়ে অনাহারেই মারা গিয়েছেন তাঁর স্ত্রী। প্রশাসনের অবশ্য দাবি, গঙ্গাম্মার কিডনির সমস্যা ছিল। সেই অসুস্থতার জেরেই তাঁর মৃত্যু হয়।

অসহায় ছিলেন বছর উনচল্লিশের রণবীর সিংহ। যাঁর মৃত্যুর পরে এমন ঘটনা শিরোনামে আসতে শুরু করে। দিল্লিতে এক রেস্তঁরায় ডেলিভারি বয়ের কাজ করতেন তিনি। দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশে নিজের গ্রামে যেতে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। দুশো কিমি যাওয়ার পরে আগরায় রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। রণবীরের মৃত্যু হয় লকডাউন শুরুর পরপরই। তার পরেই দেশের অসংখ্য মানুষের এমন পরিস্থিতির ছবি অনেক বেশি জানা যায়।

মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক না কেন, তাতে বাস্তব বদলায় না। সেই বাস্তব হল, গঙ্গাম্মা বা রণবীর বাড়ি ফিরতে পারেননি। পারেননি তাঁদের মতো আরও অসংখ্য মানুষ। তাঁরা বেরিয়ে পড়েছিলেন নিজের গ্রামের পথে। পথ সুদীর্ঘ। কারও তিনশো কিমি, কারও পাঁচশো কিমি। পথ শেষ হয়নি, পথেই জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে অনেকের। সেই মৃতদের সঠিক সংখ্যা কত বলা মুশকিল। লকডাউনের প্রথম দফা শেষের মুখে যখন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে, তখনই এমন পরিস্থিতির জেরে মৃত্যুর হার ২০০ ছুঁতে বসেছে। যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সংবাদমাধ্যমে বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হওয়া তথ্য একজোট করে। কোনও সরকারি পরিসংখ্যান নেই। লকডাউন যত অতিবাহিত হবে তখন সেই সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে তার কোনও হিসেব নেই।

হিসেব হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর। টিভির পর্দায়, ইন্টারনেটে একেবারে স্কোরবোর্ডের আদলে গোনা হচ্ছে মৃত্যুর হিসেব। হোয়টসঅ্যাপ গ্রুপে গ্রুপে প্রতি রাতেই চলে আসছে করোনায় মৃত্যুর হিসেব। আমাদের দেশে কত মৃত্যু হল, বিলেতে কত মৃত্যু হল ইত্যাদি। সেই হিসেবের অন্তরালেই ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে এই অন্য মৃত্যুর স্রোত। সেই মৃতদের মন দিয়ে দেখছি না আমরা, হিসেবও নিচ্ছি না।

এই ‘অদৃশ্য’ মৃত্যুমিছিলের প্রতিটিতে উঠে আসছে ১৩০ কোটির দেশের নির্মম বাস্তব চেহারা। জানা যাচ্ছে ২৪ বছরের এম. সুধাকরের মৃত্যুর কথা। তামিলনাড়ুর তিরুভান্নামালাই জেলার মোরাপ্পান থঙ্গল গ্রামের সুধাকর বিয়ে করেছিলেন মাস ছয়েক আগে। অন্য জাতে। গ্রামের মোড়লদের চাপে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে পারেননি। বাধ্য হয়ে কাজের খোঁজে চেন্নাই চলে যান। লকডাউনের সময় গ্রামে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন তিনি। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রীর বাবা ও আত্মীয়দের হাতে খুন হতে হয় সুধাকরকে। মারণ-ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে, মৃত্যুমিছিল ঠেকাতে সক্রিয় রাষ্ট্র। সেই সক্রিয়তায় হয়তো কাজও হচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সরাসরি প্রকোপে না হলেও তার পরোক্ষ প্রভাব আরও যে সমস্ত মৃত্যুর পরিস্থিতি তৈরি করছে তা ঠেকাবে কে?

মৃত্যুরও কত ধরন। লকডাউনে রাষ্ট্রশক্তির ‘সক্রিয়তা’র জেরেই আবার এক দলিত তরুণ আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উত্তরপ্রদেশে। খাবার কিনতে গিয়ে ওই রাজ্যেই পুলিশের পিটুনিতে মারা গেল আঠারো বছরের ক্ষুধার্ত তরুণ। ওই রাজ্যেরই লখিমপুর খেরি জেলার ফরিয়া পিপারিয়া গ্রামে বাড়ি বছর বাইশের রোশন লালের। লকডাউনে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে গুরুগ্রাম থেকে গ্রামে ফেরেন রোশন। তাঁকে অন্য শ্রমিকদের মতো গ্রামেই কোয়রান্টিন কেন্দ্রে রাখা হয়। অভিযোগ, সেখানে খাবারের খুব সমস্যা ছিল। খাবারের খোঁজে রোশন নিজের বাড়িতে যান। আটা না থাকায় তাঁকে বাড়ি থেকেই গম ভাঙিয়ে আনতে বলা হয়। তা করতে যেতেই তিনি পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। কেন তিনি েবরিয়েছেন, সেই অভিযোগে তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়। পরিচিতরা প্রায় অচৈতন্য রোশনকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পর দিন সকালেই বাড়ির অদূরে রোশনের ঝুলন্ত দেহ মেলে। মৃত্যুর আগে মোবাইলে অডিয়ো রেকর্ড করে তিনি পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন। আমাদের রাজ্যেই শোনা গেল, এক বাবা তাঁর অশক্ত প্রৌঢ় পুত্রকে হত্যা করেছেন সে মুখে মাস্ক পরতে রাজি না হওয়ায়। বাবা নিজেই থানায় গিয়ে ধরা দিয়েছেন।

করোনার পরোক্ষ কবলে পড়া এই এত রকম মানুষকে নিয়ে কে কী ভাবে ভাবছে, ভাববে, জানা নেই। লক্ষণীয়, এই ‘অনুসারী’ মৃত্যুমিছিল মূলত প্রাণ কাড়ছে তরুণদের। যাঁদের পরিশ্রমে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে দেশের অর্থনীতি। টুইটারে কয়েক জন সমাজকর্মী, গবেষক চেষ্টা করছেন এমন মৃত্যুর একটা তালিকা তৈরি করার। লকডাউনের পরিস্থিতিতে দেশের নানা প্রান্তে এমন কোনও খবর প্রকাশিত হলেই তা সেই তালিকায় যোগ করা হচ্ছে। কতে মানুষ মারা গিয়েছেন খাবার, চিকিৎসা না পেয়ে। মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে কত শ্রমিকের। কত ৩৯ জন আত্মহত্যা করেছেন এমন পরিস্থিতিতে অসহায়তা থেকে।

এই সবই খণ্ডচিত্র। পুরো ছবিটা নিশ্চয়ই জানতে পারছি না আমরা। সুতরাং, দুর্ভাগ্য, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না অবনতি হচ্ছে, সে সম্বন্ধেও কোনও তথ্য নেই আমাদের কাছে। এক মৃত্যুর আড়ালে কেবল ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অন্য মৃত্যু।


আরও পড়ুন: উনিশ শতকে কলকাতার প্লেগ বিষয়ে কী লিখেছিলেন নিবেদিতা

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy