ফেরা: আমতলায় এক ইটভাটা শ্রমিকের মেয়ে।। নিজস্ব চিত্র
ছোট্ট মেয়েটা বসেছিল একটা ব্যাগ আঁকড়ে। তাতেই বোধহয় রয়েছে টুকিটাকি কিছু সামগ্রী। ভাল নয় ব্যাগটার অবস্থা। বেশ বড় কয়েকটা ফুটো। একটু চেষ্টা করলে ব্যাগে কী আছে দেখা যাবে। তা-ও সম্পদ আগলাবার স্বাভাবিক প্রবণতায় ব্যাগের মুখটা চেপে ধরে বসে রয়েছে। সম্প্রতি মেদিনীপুর শহরের আমতলায় দেখা হয়েছিল ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে। মেদিনীপুরের আমতলায়। একটা ফাঁকা দোকানে বসেছিল সে। মেদিনীপুর গ্রামীণে বাবা-মা ইটভাটায় কাজ করতেন। বাসের জোগাড় হয়েছে এবার বাড়ি ফিরবেন সকলে। বিহারের কোনও এক গ্রামে বাড়ি তাঁদের।
পথে মানে জাতীয় সড়কে গেলেই চোখে পড়বে এমন বহুজনের। প্রতিদিন। সাইকেল, হেঁটে বা বাসে চেপে হাজারে হাজারে শ্রমিক পথে নেমেছেন। কবি পথে নামার ডাক দিয়েছিলেন। থাকলে তিনি দেখতেন, সত্যি শ্রমিকেরা পথে নেমেছেন। অন্ধকার, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে অন্তত নিজের বাড়িতে ফেরার আকূতি নিয়ে তাঁদের পথে নামা।
মেদিনীপুর শহরের কাছ দিয়ে গিয়েছে দু’দুটি জাতীয় সড়ক। একটি গিয়েছে মুম্বই, অপরটি চেন্নাই। প্রায় মাস খানেক ধরে সেই পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছেন শ্রমিকেরা। ইদানীং শ্রমিক নামের আগে বসেছে আরও একটি বিশেষণ, পরিযায়ী। খড়্গপুরের রূপনারায়ণপুর বা চৌরঙ্গী, এই জায়গাগুলিতে গেলে দেখা যাবে শ্রমিকেরা বিশ্রাম নিচ্ছেন। নতুন রেসিং সাইকেলে লাগানো ভারতের জাতীয় পতাকা। বর্ধমানের প্রশান্ত ঘোষ, খোকন মাঝি, পিন্টু মাঝিরা গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কাজ করতেন পুণেয়। টাটা মোটরসের সহযোগী এক সংস্থায়। টাকা শেষ হয়ে এল। মালিক টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন আগেই। তাই সাইকেল কিনে ফেরার চেষ্টা, জানালেন প্রশান্ত। দেখা হওয়ার আগে গত ১৫ দিন ধরে তাঁরা সাইকেল চালাচ্ছেন। রাত ৯টা সাড়ে ৯টা অবধি সাইকেল চালিয়ে কোথাও জায়গা করে ঘুমিয়ে নিতেন। ভোরে উঠে আবার সাইকেল। তবে রাস্তায় খাবারের তেমন অসুবিধা হয়নি। কোথাও না কোথাও কিছু জুটে যেত। কখনও টাকা দিয়েও কিনে খেতে হয়েছে। আর ১৫০ কিমি গেলেই বাড়ি পৌঁছতে পারবেন। এই আনন্দে একটু ঘুমিয়ে নিলেন খড়্গপুরের চৌরঙ্গীতে। পাশে বসে ছিলেন রামপুরহাটের জামিল শেখ, মহম্মদ গিয়াস, মিনারুল শেখরা। তাঁরা আসছেন মুম্বই থেকে। কখনও হেঁটে, কখনও বা রাস্তার গাড়ি ধরে গত ১২ দিন আসছেন। আর দু’দিন মতো লাগবে রামপুরহাট পৌঁছতে। তাই হাসি মুখে বললেন, না রাস্তায় কোনও অসুবিধা হয়নি। অনেক ট্রাকওয়ালা টাকাও নিতে চাননি। আর খাবারের কোনও অসুবিধা নেই। অনেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন খাবার দেওয়ার জন্য। নিজেদের টাকা খরচ করতেই হয়নি। একটু জিরিয়ে আবার হাঁটা শুরু হল জালিম, মিনারুলদের।
কয়েক কিলোমিটার দূরেই রূপনারায়ণপুরের ওভারব্রিজের তলায় পাশাপাশি বসে খাচ্ছিলেন শ্রীরাম ঠাকুর, রাজেশ সিংহদেব, মুকেশ কুমাররা। দেহাতি হিন্দিতে জানালেন, হায়দরাবাদে এক রাইস মিলে কাজ করতেন। লকডাউনে মিল বন্ধ হয়ে গেল। হাতের টাকা ফুরিয়ে গেল। তাই হেঁটে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেন। দলে ১৮ জন আছেন। টানা ২০ দিন হেঁটে আসছেন। থাকেন বিহারের শ্রীপাল জেলায়। তাঁদের হিসেবে আরও ৮-১০ দিন হাঁটতে হবে। কাল সকালে কিছু বিস্কুট জুটেছিল। তার পরে আজ পেট ভরে খেলেন। দাঁতনের চেকপোস্টে পুলিশকে পাশ দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। পুলিশ বলেছে, ‘কিছু লাগবে না, চলে যাও’, জানালেন মুকেশ। খেয়ে কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে ‘বাঙালিবাবুদের পরনাম’ জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন মুকেশরা। গুগল ম্যাপ বলছে ১৩৯৪ কিমি হেঁটে এসেছেন তারা, আরও ৬২০ কিমি হাঁটতে হবে।
বিশাখাপত্তনম থেকে হেঁটে বা ট্রাকে চড়ে এসেছেন মনিরুল মোল্লা, সাকিনা বিবি, ফিরোজা বিবিরা। কাজ করতেন সেখানের ইটভাটায়। কাজ বন্ধ। বেতনও বন্ধ। অগত্যা বাড়ি ফেরা। যাবেন বসিরহাট। একটা ঝড়ের কথা শুনেছেন, তবে ঠিকমতো জানেন না। মোবাইলে চার্জও নেই। বাড়ির কী খবর অনেকদিন তা পাননি। আগে তো পৌঁছই, তারপরে দেখা যাবে, বললেন মনিরুল। তখনও আমপান আছড়ে পড়েনি। পাশ দিয়ে বাস ট্রাক চলে যাচ্ছে। হাত দেখিয়ে তাই দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন ২৫ জনের দলের সকলে। মেদিনীপুর শহরের পাশে আমতলায় আবার পূজা কুমারীর খুব আনন্দ। বাবা-মায়ের সঙ্গে কাছের এক ইট ভাটায় কাজের জন্য এসেছিল। মালিক নিজেই ভাড়া দিয়ে বাস ঠিক করে দিয়েছেন। তাতেই বাড়ি ফিরছে পূজা।
আবার শ্রমিকেরা পথে একা নন। রয়েছেন ভুঁইয়া পরিবারের সদস্য মধুসূদন, যাদব, দেবাশিস ও শুভাশিস রাও। চার ভাইয়ের হার্ডওয়ার্সের দোকান। ক’দিন ধরেই তাঁরা খেয়াল করছিলেন দলে দলে লোক ওড়িশার দিক হেঁটে থেকে আসছেন। এই মোড়ে এসে তাঁরা রাস্তা জানতে চাইছেন, আবার হাঁটা শুরু করছেন। কেউ কেউ সাইকেলেও আসছেন। কয়েকদিন ধরেই টিভিতে কাগজে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা পড়েছেন। তাঁদের দুর্দশার ছবিও দেখেছেন। এবার চোখের সামনে সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের কষ্ট দেখা শুরু হল। চার ভাই মিলে ঠিক করলেন, কিছু একটা করতেই হবে। বাড়িতেই খাবার রান্নার ব্যবস্থা করলেন। দোকানের মালপত্র নিয়ে যাওয়ার পিকআপ ভ্যানে তা নিয়ে আসতে শুরু করলেন দূরে জাতীয় সড়কের মোড়ে। সেখানে বিশাল বড় ফ্লাইওভার। তার তলায় জায়গা পরিষ্কার করে বড় পলিথিনের চাদর পেতে পরিযায়ীদের বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিছুটা জিরিয়ে নেওয়ার পরে সেখানে তাঁদের ভরপেট খাবার খাওয়ানোর বন্দোবস্ত। চার ভাই মিলে এই কাজ করে যাচ্ছেন বেশ কয়েকদিন ধরে। একজন স্কুটি নিয়ে তৈরি। একটু দূরে বাস আসতে দেখলেই গিয়ে খাবার লাগবে কিনা তা জানতে চাইছেন। যাঁরা হেঁটে বা সাইকেলে আসছেন তাঁদের নিয়ে আসছেন খাবার খাওয়ানোর জন্য। পেট ভরে খাইয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর তাঁদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোন পথে যেতে হবে। চার ভাই মুকেশ, রাজেশদের খাওয়ালেন।
যাদব বললেন, ‘‘দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকদের হেঁটে যেতে দেখে মনে হয়েছিল আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। তাই চার ভাই নেমে পড়লাম। সব নিজেদের খরচে। কোনওদিন ভাত আনাজ, কোনওদিন খিচুড়ি। দিনে মোটামুটি ১০০ বা তার কিছু বেশিজনকে খাবার দিতে পারছি। এই শ্রমিকরাই তো আমাদের দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমরা আর কতটুকু করতে পারলাম।’’
অনেকেই তো অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য সাইকেলে দেশ ভ্রমণ করেন। কেউ হেঁটেও। আর এই শ্রমিকেরা জীবনের তাগিদে পথে নেমেছেন। হয়তো জীবনকে আরও একবার নতুন করে চিনে নিতেও পারলেন। ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ একদল লোক হাঁটছিলেন। মায়ের স্নেহভরা কোলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। কিন্তু শ্রমিকেরা হেঁটে চলেছেন ভিন্ কোনও রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’তে পৌঁছনোর অদম্য জেদ নিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy