Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

লকডাউন সমস্যায় ফেলেছে প্রচুর, শিক্ষাও দিচ্ছে অনেক

লকডাউন চলুক। একই সঙ্গে নিশ্চিত হোক নিরন্ন মানুষের অন্ন-বস্ত্র-থাকার অধিকার। লিখলেন নমিতেশ ঘোষ আমাদের কিছু যায় আসেনি। শুধু একজন জামলোর মৃত্যু হয়েছে। তপ্ত দুপুরে পথে হাঁটার সময় কোনও ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়ালে দেখি লাইন দিয়ে রয়েছেন বহু মানুষ।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২০ ০৬:১৮
Share: Save:

ছোট্ট মেয়েটার ছবি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে কয়েকদিন ধরেই। ঘুমোতে যাই, ঘুম থেকে উঠি। আমার চার বছরের মেয়ের সঙ্গে খেলতে বসি, আমরা পুতুল-পুতুল খেলি। ওই ছোট্ট একরত্তি মেয়ে আমায় বলে, ‘বাবা এখন তো করোনাভাইরাসের জন্য লকডাউন চলছে। কোত্থাও যাওয়া যাবে না। চলো, আমরা ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।’ আমি সেই ঘোরের মধ্যেই ডুবে রয়েছি। বিজাপুরের সেই জামলো মকদম আমার চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ে। একটু ভাতের খোঁজেই হয়তো সে পাড়ি দিয়েছিল বহু ক্রোশ পথ। না, তবুও হয়তো সেই ভাত নিয়মিত পড়ত না তার পেটে। খিদে, অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা জামলো তিন দিন হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। বাড়ি ফেরেও সে। তার দেহ ততক্ষণে নিথর হয়ে যায়।

আমাদের কিছু যায় আসেনি। শুধু একজন জামলোর মৃত্যু হয়েছে। তপ্ত দুপুরে পথে হাঁটার সময় কোনও ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়ালে দেখি লাইন দিয়ে রয়েছেন বহু মানুষ। শিশু কোলে মা, লাঠি হাতে বৃদ্ধা। আধভাঙা চশমা চোখে প্রৌঢ়া। জীর্ণ শরীরে অপুষ্টির ছাপ নিয়ে কোনও তরুণী। ময়লা-জীর্ণ পোশাকের কোনও তরুণ। জনধন যোজনার পাঁচশ টাকার জন্য! আমাদের অস্বস্তি হয়। টিভি-র পর্দায় ওই লাইন দেখে রাগও হয়েছে। বলেছি, এই মানুষগুলির জন্যই আমরা করোনায় আক্রান্ত হব। কখনও ভেবে দেখিনি, কেন এই তপ্ত দুপুরে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে আছেন এত মানুষ? শুধু ৫০০টি টাকার জন্য! ওই টাকা তো আমাদের এক সন্ধেতেই উড়ে যায়। কখনও ওই মানুষদের বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করিনি, আজ কি রান্না হয়েছে? আদৌ কি হয়েছে রান্না?

হাঁক দিচ্ছেন কেউ। ‘মাস্ক লাগবে গো মাস্ক?’। কারও চোখে আর্তি, দাদা কাজ পাওয়া যাবে? সকালের বাজারে অশীতিপ্রায় বৃদ্ধা জঙ্গল থেকে তুলে আনা দু’টি ঢেঁকি শাক নিয়ে বসে রয়েছেন। কুড়িটি টাকা যদি পকেটে আসে। আবার ভিক্ষার থলি হাতেও মানুষের দেখা মিলছে রাস্তায়। আমরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিই তাঁদের। না হলে বাড়ির সদর দরজায় ঝুলিয়ে দিই তালা। যাতে ওই অবাঞ্ছিতদের কেউ আমার বাড়ির চত্বরে ঢুকতে না পারেন। আমি তো তাঁদের জন্য নিজেকে অসুরক্ষিত রাখতে পারি না। একশো বার। লকডাউনের বাজারে এমনটাই তো হওয়া উচিত। আমাদের কিন্তু মনে হয়নি কেন এই মানুষগুলি সব কিছু উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন।

বাদল, আয়ুব, আলমরা বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে রয়েছেন। বাড়ি ফিরতে চাইছেন তাঁরা। আমাদের ঘোর আপত্তি। সরকারও রাজি হয়নি। স্পষ্টতই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে যেখানে রয়েছেন, সেখানেই থাকবেন। করোনাভাইরাস সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ফিরতে পারেন তাঁরা, এই সংশয় রয়েছে সকলের। একদম ঠিক। এই মুহূর্তে তাঁদের কোনওমতেই ফিরতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা কি খোঁজ নিয়েছি, ওই মানুষেরা কী ভাবে আছেন? কেনই-বা ওই মানুষেরা আত্মীয়-পরিজন-জন্মভূমি ছেড়ে যুগ যুগ ধরে পাড়ি দিয়েছেন অজানার উদ্দেশে? যে কোনও আদিবাসী গ্রামে গেলেই চোখে পড়বে, হাঁড়িয়া নিয়ে বসেছেন একদল মানুষ। আমাদের প্রশ্ন, লকডাউনের মধ্যে এই কারবার চললে কত ক্ষতি হয় জানা আছে? একবার থাবা বসালে ছড়িয়ে পড়তে শুধু মুহূর্তের অপেক্ষা থাকবে। কিন্তু কেন এই আদিবাসী মহল্লায় হাঁড়িয়ার কারবার হয়?

আমরা এখনও দেখি, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা উলঙ্গ ভবঘুরেকে, ধর্মস্থানের সামনে হাত পেতে বসে থাকা ভিক্ষুকের দলকে। আজও দেখা যায়, হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাজার থেকে এক মুঠো চাল আর আনাজ নিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরছেন হোলংয়ের বাবা। এই ছবিগুলো আমাদের চেনা। যেমন, চেনা জামলোর সেই মৃতদেহ। জামলোদের মরে থাকার সেই খবর আমরা কখনও জানি বা কখনও জানতেও পারি না।

আমার চারপাশে এমনই তো সব ঘটে চলেছে যুগ যুগ ধরে। আমরা সবই বুঝি। আসলে, এই করোনাভাইরাস আর লকডাউন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সেই সব মানুষদের। যাঁদের প্রতিটি মুহূর্ত জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। মারণ ভাইরাসের ভয় সকলের। এই নিরন্ন মানুষদের মধ্যে হয়তো নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ৪৪ শতাংশ মানুষ খাওয়া কমিয়েছেন বা একবেলা খাচ্ছেন। কারণ, সংক্রমণের ভয়। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।

তা সেই যাই হোক না কেন, করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে হলে লকডাউনের বাইরে অন্য পথ নেই। একমত। সবার কাছেই আবেদন রাখব, লকডাউন মেনে চলুন। ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। সেই সঙ্গে মনে হয়, ভাবার সময় এসেছে গ্রামের এই দিন-আনা দিন-খাওয়া নিরন্ন মানুষদের কথা। রাজনৈতিক নেতারা ত্রাণ নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু এই ত্রাণ দিয়ে কি সকলের খিদে মেটে? তাই করোনাভাইরাসের প্রকোপে যেমন সমস্যা তৈরি হয়েছে, তেমনই শিক্ষা দিয়েছে অনেক। সেই শিক্ষা থেকেই প্রত্যেকটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।

জামলোদের মৃত্যুপথে ছেদ টানতে হবে।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy