একটি কথা স্পষ্ট— এত দিন অর্থনীতি যে ভঙ্গিতে চলিয়াছে, তাহা আর চলিতে দেওয়া যায় না। আর্থিক সমৃদ্ধি বণ্টনে যে অসাম্য, তাহা দূর না করিতে পারিলে বিপদ গভীরতর হইবে। ইতিমধ্যেই ইতস্তত রব উঠিয়াছে, সমাজতন্ত্রের অভ্যুত্থান অনিবার্য। অনেকেই এই কলরবে গত শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক মডেলে ফিরিবার স্বপ্ন দেখিতেছেন। সোভিয়েট ইউনিয়ন হইতে পূর্ব ইউরোপ এবং দেং-পূর্ববর্তী চিন— বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের দীর্ঘ ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে, সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্র চালু করিলে বণ্টনের ক্ষেত্রে স্থায়ী সুরাহা হয় না, শুধু উৎপাদন ব্যবস্থা তাহার কুশলতা হারায়, শেষ অবধি দারিদ্র তীব্রতর হয়। অসাম্যও যে শেষ অবধি কমে না, রাশিয়া এবং চিনের বর্তমান চিত্রই তাহার প্রমাণ হিসাবে যথেষ্ট। না, ধনতন্ত্রের বর্তমান সঙ্কটের উত্তর সমাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন নহে। বস্তুত, যে আর্থিক সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে, ধনতন্ত্রের আত্মশুদ্ধির অদম্য স্পিরিট-এই তাহা হইতে নিস্তারের পথ খুঁজিতে হইবে।
কিন্তু, যে বাধানিষেধহীন— লেসে ফেয়র— পুঁজিবাদের কথা শিকাগো স্কুল বলিয়া থাকে, এই সময়টি তাহার জন্য নহে। রাজনৈতিক দর্শনের দুনিয়ায় একটি প্রসিদ্ধ বিতর্ক বর্তমান সময়ের পথনির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লইতে পারে— জন রল্স বনাম রবার্ট নজ়িকের বিতর্ক। কালানুক্রমিক বিচারে যদিও নজ়িক রল্সের পরবর্তী, কিন্তু বর্তমান আলোচনায় তাঁহার কথা পূর্বে উল্লেখ করাই বিধেয়। নজ়িক ন্যূনতম সরকারে বিশ্বাসী, অর্থাৎ কেহ যদি ন্যায্য পথে আপনার (উদ্ভাবনী) শক্তি ব্যবহার করিয়া উৎপাদন করিলে তাহার উপর সম্পূর্ণ অধিকার সেই ব্যক্তির— ন্যূনতম প্রশাসন পরিচালনার জন্য যে সামান্য অর্থ প্রয়োজন, তাহার অতিরিক্ত আর কিছুই তাঁহার রাষ্ট্রকে দেওয়ার নাই। ‘লিবারটারিয়ান’ আর্থিক দর্শন এই অবস্থানই গ্রহণ করিবে। এবং, বিশ্বের বেশির ভাগ প্রান্তেই ধনতন্ত্র ক্রমে এই রূপ হইয়া উঠিয়াছে। অবস্থানটির পক্ষে যুক্তি আছে, কিন্তু বিপক্ষে একটি যুক্তি অকাট্য— কোনও রাষ্ট্রে বা অর্থব্যবস্থায় প্রত্যেকের প্রাথমিক সম্পদের পুঁজি সমান নহে। ফলে, আপন ভাগ্য গড়িয়া লইবার বলও সম ভাবে বণ্টিত নহে। কেন প্রাথমিক সম্পদের পুঁজি অসম, সেই দীর্ঘ আলোচনায় আপাতত ঢুকিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে তাহার সমাধানের পথ সন্ধান করা বাঞ্ছনীয়।
আরও পড়ুন: ‘অনলাইনে পড়ানো একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা’
রল্সের দর্শন সেই পথের কথাই বলে। তিনি আদি অবস্থা-র কথা কল্পনা করিতে বলিয়াছেন— যেখানে সমাজের কোনও মানুষই জানিবেন না যে সমাজে তাঁহার অবস্থান কী হইবে; কিন্তু প্রত্যেকেই জানিবেন, কোন অবস্থায় প্রাথমিক পুঁজি এবং জীবন-সম্ভাবনা কী রকম। অর্থাৎ, কাহার ভাগ্যে কী জুটিবে, তাহা নির্দিষ্ট হইবার পূর্বেই প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী সেই পরিণতিকে মানিতে সম্মতি জানাইবে। এই অবস্থায় সমাজ সম্পদ বণ্টনের যে পন্থা গ্রহণ করিবে, রল্সের মতে, তাহাই ন্যায্য বণ্টন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেই বণ্টনের নীতি প্রবর্তন। এই মুহূর্তে এই ন্যায্য বণ্টনের অন্তর্নিহিত ধারণাটি ধনতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হইতে পারে। বাজার যদি আপন শক্তিতে উৎপাদনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করিয়া চলে, এবং রাষ্ট্র যদি ন্যায্যতার শর্ত মানিয়া সেই উৎপাদনকে বণ্টন করিতে থাকে, তবেই অর্থনীতির নিস্তার সম্ভব। সমাজতন্ত্রের নামধারী রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের ব্যর্থ মডেল নহে, প্রয়োজন বণ্টনের ন্যায্যতার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy