রেলমন্ত্রী-সহ মোদী-শাহের অদূরদর্শিতার ফলভোগ করতে হচ্ছে বাংলার মতো রাজ্যগুলিকে। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতের করোনাভাইরাস অতিমারি বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও হতাশাজনক দিকটি হল পরিযায়ী শ্রমিকদের ভাগ্য। অন্য রাজ্যে আটকা পড়া শ্রমিকরা হঠাৎ করে চাকরি, জীবিকা এমনকি মাথার উপরে ছাদও হারিয়েছে। প্রথম মুহূর্ত থেকেই একটা কথা পরিষ্কার ছিল। অর্থনৈতিক এবং মানসিক প্রয়োজনীয়তার তাগিদে পরিযায়ী শ্রমিকদের এ বার নিজেদের বাড়ি ফিরে আসতে হবে। নিজের গ্রামে নিজস্ব পরিবারের সঙ্গে থাকার সুরক্ষা কে না চায়?
যে হেতু মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল, তাই এটা সম্ভব হয়নি। এবং এই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সারা দেশ চাক্ষুষ করল এক ঘৃণ্য, হৃদয়বিদারক ঘটনা। এটা সহজেই এড়ানো যেত। সাংসদদের দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরতে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল— কিন্তু এই অসহায় গরিব মানুষগুলোকে দেওয়া হয়েছিল মাত্র চার ঘণ্টা!
একটা বিকল্প পরিস্থিতির কথা ভেবে দেখুন। ভারতীয় রেল দিনে ২.৩ কোটি যাত্রী বহন করতে পারে। এর প্রায় অর্ধেক যাত্রী মুম্বই, কলকাতা এবং চেন্নাইয়ের মতো শহর বা শহরতলিতে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করেন। অতএব, দূরপাল্লার ট্রেনে দৈনিক ১.২ কোটি যাত্রী যাতায়াত করেন।
আরও পড়ুন: ক্ষমতাদখলের লড়াই ঠেকাবে, অতিমারিরও সেই সাধ্য নেই
লকডাউনের সময় সমস্ত যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ ছিল। সুতরাং, এই সময় রেল চাইলেই দৈনিক ১.২ কোটি যাত্রিবাহী ট্রেন পরিষেবা চালাতে পারত। সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ মেনে, ভারতীয় রেল প্রতি দিন অন্তত ৬০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পৌঁছে দিতে পারত। নিজের গ্রামে না হোক, তাঁরা অন্তত নিকটবর্তী শহরে পৌঁছে যেতে পারতেন।
এই হিসেব অনুযায়ী লকডাউনের প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে ৩ কোটি শ্রমিক যাতায়াত করতে পারতেন। ধরে নেওয়া যাক, পূর্ব ভারতের রুটে প্রচুর ট্র্যাফিক হত। কারণ সেখানেই বেশির ভাগ পরিযায়ীরা ফিরে যেতেন। সেই ক্ষেত্রে এই পাঁচ দিনের সময়সীমা বাড়িয়ে এক সপ্তাহ করা যেত। শুধু এটুকুই তো প্রয়োজন ছিল।
এই সময়ে রেল মন্ত্রক শুধুই মরীচিকার পিছনে ছুটে বেরিয়েছে। করোনা-সংক্রমিত রোগীদের জন্য পাঁচ হাজার অশীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কোচগুলি কোথায়? ক’টা কোচ ব্যবহার করা হয়েছে? সর্বোপরি, এই ভরা গ্রীষ্মে রোগীরা কী ভাবে অশীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচগুলিতে বেঁচে থাকতে পারবেন? শুধুমাত্র খবরের শিরোনামে আসার তাগিদে ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে?
আরও পড়ুন: দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বে নজর ঘুরেছে আসল ভোটব্যাঙ্কের দিকে
গত ১ মে, ঢাকঢোল পিটিয়ে পরিযায়ীদের জন্য বিশেষ ট্রেন পরিষেবা চালু করা হয়েছিল। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে আমদানিহীন, কপর্দকশূন্য এই শ্রমিকদের রেলের ভাড়া বাবদ টাকা দিতে বলা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের রেলের ভাড়া নাকি দিতে হচ্ছে না। বিভিন্ন ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে কেন্দ্র দাবি করেছে যে রেল ভাড়ার ৮৫ শতাংশ তারাই বহন করছে।
গুটিকয়েক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরছিল। তারা যে সকল পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁদের অধিকাংশই কেন্দ্রের এই দাবি নস্যাৎ করেছেন। শ্রমিকেরা জানিয়েছেন ট্রেনের টিকিট তাঁদের কিনতে হয়েছে। কিছু শ্রমিককে তো টিকিটের পয়সা জোটাতে ঋণও নিতে হয়েছে। যেহেতু ট্রেনের ভাড়া শতাব্দী ও রাজধানীর মত প্রিমিয়াম ট্রেনগুলির সমান রাখা হয়েছে, তাই পরিযায়ী শ্রমিকদের টিকিট বাবদ ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়েছে। এ ছাড়া, স্টেশনে যাওয়াআসার জন্য বাসের ভাড়া উপরি।
কেন্দ্র যেখানে নিজের দায়িত্ব অগ্রাহ্য করেছে, রাজ্যগুলি সেই দায়িত্ব সাগ্রহে পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, রাজ্যে ফেরত আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের যাতায়াতের খরচ পুরোটা বহন করেছে বাংলা।
কেন্দ্রীয় সরকার ট্রেনগুলি চালায় ঠিকই, কিন্তু এর আনুসাঙ্গিক সমস্ত কাজ রাজ্য সরকারগুলিকে করতে হয়। রাজ্যে যাঁরা প্রবেশ করছেন, সেই সকল যাত্রীদের স্ক্রিনিং করতে হয়। বাড়িতে বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়রান্টিনে থাকাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকদের নজরদারি চালাতে হয় রাজ্যকেই। কোভিডের উপসর্গ আছে এমন যাত্রীদের হাসপাতালে পাঠানো এবং চিকিৎসার দায়িত্বও নিশ্চিত করে রাজ্যগুলিই। সুতরাং, একটি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালাতে যে রাজ্য থেকে ট্রেন ছাড়ছে, গন্তব্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয় দরকার। রাজ্যগুলি প্রস্তুত থাকলে তবেই ট্রেন চালানো উচিত।
এখানেও রেল মন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে ক্ষুণ্ণ করেছে এবং নিজেদের খামখেয়ালিপনার নিদর্শন রেখেছে। কোনও সময়সারণি মেনে ট্রেন চলেনি। মহারাষ্ট্র বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরাতে আগ্রহী ছিল। বাংলাও তাদের স্বাগত জানাতে আগ্রহী ছিল। সমস্ত সুরক্ষাবিধি বজায় রেখে দুই রাজ্য সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে রাজ্যে ফেরানোর পরিকল্পনা করছিল। এরই মধ্যে মহারাষ্ট্র-বাংলার মধ্যে ৩৭টি ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় রেল। একের পর এক। ঝড়ের গতিতে। রাজ্য সরকারগুলিকে জানানো তো হয়ইনি, উল্টে দুই রাজ্যের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টাও করা হয়।
হয়রানির শেষ এখানেই নয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আরোগ্য সেতু অ্যাপটি বাধ্যতামূলক নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে ভারতীয় রেলকে কোনও নির্দেশও দেওয়া হয়নি যে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ভাবে এই অ্যাপটি ডাউনলোড করতে হবে। তা সত্ত্বেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। রেলওয়ে জোনাল অফিসগুলিতে ট্রেনে চড়ার আগে অ্যাপটি ডাউনলোড করতে যাত্রীদের লিখিত ভাবে নয়, মৌখিক ভাবে বলা হয়েছিল। এটি করা হয়েছে ট্রেন ছাড়ার কিছু আগে। চিন্তা-ভাবনা না করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
বাংলার মতো রাজ্যগুলি, যারা এই মহামারীর বৃদ্ধি রোধ করতে পেরেছে, তাদের এই অদূরদর্শিতার ফলভোগ করতে হচ্ছে। আজ বাংলায় প্রতি দিন গড়ে ৯,০০০ পরীক্ষা হচ্ছে, যার মধ্যে মাত্র ২.৫ শতাংশ নমুনা পজিটিভ আসছে। যদি পরিযায়ী শ্রমিকদের ধীরে ধীরে ফেরত পাঠানো হত, তা হলে হয়তো এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হত না। কিন্তু ভারতীয় রেল গণ্ডায় গণ্ডায় লোক পাঠাচ্ছে রাজ্যে। এর ফলে ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চিত। মো-শা এবং তাদের রেল মন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হবে। অপেক্ষা শুধু সংসদ চালু হওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy