Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
২০০৮ তো বটেই, এমনকি ১৯৩০-এর দশকও ছায়া ফেলছে
Coronavirus

‘মহামন্দা’র পথে দুনিয়া?

এমন চললে মে মাসের শেষের মধ্যে প্রায় সব বিমান সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা।

আপাতত গোটা পৃথিবী জুড়ে বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ, পর্যটন স্তব্ধ, হোটেল, খাবার দোকান সবেতেই তালা ঝুলছে।

আপাতত গোটা পৃথিবী জুড়ে বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ, পর্যটন স্তব্ধ, হোটেল, খাবার দোকান সবেতেই তালা ঝুলছে।

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

লালবাতির নিষেধ ছিল না, তবু ঝড়ের বেগে ধাবমান মানব সভ্যতা অতর্কিতে থেমে গেছে। শিল্প-বাণিজ্য-বিশ্বায়ন, পরিবেশ দূষণের উদ্দাম গতি, সব কিছু থমকে দাঁড়িয়েছে এক মাসের মধ্যে। করোনা-উত্তর পৃথিবীতে মানুষ কবে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে ফিরবে, তার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।

আপাতত গোটা পৃথিবী জুড়ে বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ, পর্যটন স্তব্ধ, হোটেল, খাবার দোকান সবেতেই তালা ঝুলছে। এমন চললে মে মাসের শেষের মধ্যে প্রায় সব বিমান সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। পর্যটন-শিল্পেও একই কালো মেঘ। শিল্পের যে ক্ষেত্রগুলো কাজ তৈরি করে, তার মধ্যে প্রধানই হল ভ্রমণ ও পর্যটন— পৃথিবীব্যাপী আনুমানিক ২০ শতাংশ মানুষের জীবিকার কেন্দ্র। ফলে যে সংখ্যায় মানুষ কাজ হারাতে চলেছে আগামী এক-দুই মাসে, তার হিসেব আন্দাজ করা যায় না। যে দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনের গুরুত্ব যত বেশি, যেমন মূল ইউরোপের কয়েকটি দেশ, ব্রিটেন, তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ইত্যাদি, সেখানে আঘাতের তীব্রতাও হবে ততটাই।

‘ম্যানুফ্যাকচারিং’ শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে গত কয়েক দশকে চিন নিজেকে নিরঙ্কুশ ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে, আজকে পৃথিবীর কোনও দেশে এমন কোনও শিল্প প্রায় নেই, যারা চিন থেকে কাঁচামাল কেনে না। এই বিশ্বায়িত শিল্পসাম্রাজ্যে এখন দমবন্ধ অবস্থা, কারণ জাহাজ চলাচল থমকে গেছে। ভারতেও চিনা সামগ্রীর রমরমা। আমরা আপাত ভাবে যা দেখি, তার আড়ালেও আছে এক বিরাট নির্ভরতার ক্ষেত্র। ভারতের ওষুধপত্র ও কীটনাশকের কাঁচামাল প্রায় পুরোটাই আসে চিন থেকে। ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া থেকে আসে কয়লা, ডাল, ভোজ্য তেল ইত্যাদি। তাই এক অভূতপূর্ব সংকটের করালগ্রাসে দেশ ও বিশ্বের অর্থনীতি।

পৃথিবীর অর্থনীতির মাপ মোটামুটি ৮০ ট্রিলিয়ন ডলার। ক্ষতির প্রাথমিক হিসেব ছিল আনুমানিক এক ট্রিলিয়ন ডলার, কিন্তু আপাতত এই হিসেব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। চিনকে বাদ দিলে ভারতসহ পৃথিবীর সব শেয়ার মার্কেটে অবিরাম রক্তক্ষরণ চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৮ সালের আর্থিক ‘মন্দা’র পরিস্থিতি অাবার ফিরে এসেছে। মাসখানেকের মধ্যে পরিস্থিতির মোড় না ঘুরলে হয়তো আমরা ১৯৩০ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ এর সঙ্গে তুলনীয় জায়গায় পৌঁছে যাব, যেখানে করোনাপূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরতে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এই মহামন্দার চাপে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ শতাংশ শিল্পসংস্থা দেউলিয়া হতে পারে, তার সঙ্গে থাকবে অসংগঠিত বা ক্ষুদ্রশিল্পে কাজ হারানোর ভয়াবহ ভবিতব্য।

ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, চিন, সব দেশেই সরকার এখন ব্যস্ত, মন্দার গ্রাস থেকে দেশকে কী ভাবে বাঁচানো যায় তার পথ খুঁজতে। এক ধাক্কায় আমেরিকায় ৩০ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে যেতে পারে। করে ছাড়, সুদের হার কমানো, বেতনে ভর্তুকি দেওয়া— নানা রকম ঘোষণা চলছে। আমেরিকা দুই ট্রিলিয়ন ডলারের মতো ত্রাণ ঘোষণার পথে। ব্রিটেন চাকরি হারানো সকলের জন্য কিছু দিন মাসে ২৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত ভর্তুকি দেবে। কিন্তু মূল সমস্যা হল, এই সব কিছুই সংগঠিত শিল্পের জন্য। ক্ষুদ্রশিল্প ও স্বনির্ভর মানুষকে স্বস্তি দেবার মতো কোনও কিছুই শোনা যায়নি।

ভারতের অবস্থা আরো সঙ্গিন। জিএসটি আর নোটবন্দির অভিঘাতে গত দু বছর ধরে ধুঁকতে থাকা একটা অর্থনীতিতে সুনামির মত আছড়ে পড়েছে করোনা। গ্রামীণ ও প্রান্তিক অর্থনীতির সঙ্কট তো ছিলই, এখন যোগ হবে শহর বা পুর অঞ্চলের আর্থিক সঙ্কোচন। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক কোনও সুরাহার ঘোষণা এখনও হয়নি, যদিও শোনা গিয়েছে একটা টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির অবস্থা এতটাই দেউলিয়া যে, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে তলানিতে ঠেকলেও মানুষ সেই সুবিধে ছিটেফোঁটাও পাচ্ছে না, কারণ সরকার এই সুযোগে শুল্ক চাপিয়ে ঘাটতি পোষাতে ব্যস্ত। বিভিন্ন মহলে আশঙ্কা, এই নজিরবিহীন সঙ্কটে কোনও আর্থিক সুরাহার পথ দেখাবার মতো ভাঁড়ার সরকারের কাছে নেই, কারণ ঘাটতির হার বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এবার হয়তো নোট ছাপাতে হবে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে। সঙ্কটকালে অর্থনীতির হাল ধরার মতো প্রজ্ঞা এই সরকারের আছে, তার কোনও নিদর্শন গত ছয় বছরে দেখা গিয়েছে বলে মনে হয় না। বরং খুব সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও এই সঙ্কটে বুক চিতিয়ে কিছুটা ভরসা দেবার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে রাজ্য-স্তরে, যার পুরোভাগে আছে কেরল আর পশ্চিমবঙ্গ।

তাকানো যাক একটা অন্য ছবির দিকে। নির্দিষ্ট উত্তর অজানা থাকলেও প্রশ্ন উঠে আসছে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে। এটা ভাবা হয়তো অমূলক নয় যে বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। আসলে আতঙ্ক আর ভয় যে গতিতে মানুষের মনে প্রভাব ফেলে, ভরসা বা আস্থা ফিরে আসতে তার বহুগুণ সময় লাগে। করোনার মহামারি রূপটা কখনও আয়ত্তে আসবে, কিন্তু এই ভাইরাসের ভয় বা প্রভাব সহজে যাবে না। তাই আবার কবে ট্রেন বা প্লেনে মানুষ ঘেঁষাঘেঁষি করে যাতায়াত করবে, দল বেঁধে বেড়াতে যাবে, লাইন দিয়ে দাঁড়াবে, ক্লাসরুম-এ পাশাপাশি বসবে, ভরা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখবে, তার উত্তর নেই। তাই পর্যটন, পরিবহণ, শিক্ষা, খেলা, বিনোদন ক্ষেত্রে ব্যবসার মডেলে আমূল পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। শেয়ার মার্কেটে ধসের ফলে বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোর সম্পদ যে হারে কমছে, তাতে সংগঠিত শিল্পে বা স্টার্ট-আপ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ব্যাকরণটাই বদলে যেতে পারে। বহুজাতিক সংস্থাগুলো যে ভাবে তাদের ব্যবসা সাজাচ্ছিল, তার খোলনলচেও বদলাতে পারে।

প্রায় সব ধরনের দ্রব্যসামগ্রীর কাঁচামালের ক্ষেত্রে চিনের ওপর যে অতিনির্ভরতা গড়ে উঠেছে— তার থেকে এবার বোধহয় সকলেই বেরিয়ে আসতে চাইবে। চিন ছাড়াও এশিয়ার অন্য দেশে যেখানে শ্রমিকের মজুরি কম— সেখানে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর অন্তত আর একটি কেন্দ্র হয়তো সকলেই চাইবে ব্যবসার ঝুঁকি কমাতে। সে ক্ষেত্রে একটা বড় সুযোগ আসতে পারে ভারত, বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামের কাছে। অন্য দিকে অনলাইন শিক্ষার পরিকাঠামো, ডিজিটাল স্বাস্থ্য পরিষেবা, অনলাইন বাজার, ডিজিটাল বিনোদন, এই সবের রমরমা বাড়বে। ঠিকমতো পরিকল্পনা করতে পারলে ভারত এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে।

অর্থনীতির আর এক চালিকাশক্তি: রাজনীতি। আশঙ্কা হচ্ছে, দ্বার বন্ধ করে-দেওয়া জাতীয়তা আর স্বদেশির আবেগে দক্ষিণপন্থী উদ্যোগ মাথা তুলবে বহু দেশেই। অন্য দিকে এই আণুবীক্ষণিক ভাইরাসটি বাজার অর্থনীতির দর্শনকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেতে চলেছে আমেরিকা, শুধু সময়ের অপেক্ষা। বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে সেখানে। স্পেনের সরকারকেও সমস্ত বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র অধিগ্রহণ করে নিতে হয়েছে বিপর্যয় সামলাতে। ‘গভর্নমেন্ট হ্যাজ় নো বিজ়নেস ইন স্টেয়িং ইন বিজ়নেস’— মুক্ত অর্থনীতির এই আপ্তবাক্যের প্রবক্তাদের থেকে সব দেশেই সরকারের কাছে ভাঁড়ার খুলে দেবার চাপ আসছে— সামাজিক সুরক্ষা, ন্যূনতম আয়, এই সব কথা নতুন করে শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে আটকে-যাওয়া ভারতীয় নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার যে কাজ এয়ার ইন্ডিয়া করছে, কয়েক মাস আগে বিক্রি হয়ে গেলে সেই কাজ সম্ভব হত কি না গভীর সন্দেহ। সুখের সময় বাজার অর্থনীতি, আর বিপদে পড়লে সরকার মা-বাপ– এই দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সমাজতন্ত্রের সলতে পাকানো আবার শুরু হবে কি না, তা সময়ই বলবে।

ঘর ছেড়ে বাইরে তাকানো মানুষের হাত ধরে গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বায়িত অর্থনীতির যে জয়যাত্রা— অজানা ভয়ে ঘরের কোণে সিঁটিয়ে যাওয়া মানুষ সেই গতিপথ বদলে দেবে কি না, তা দেখার জন্য আমরা এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

লেখক ইনকিউব অধিকর্তা

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy