মধ্যযুগে প্লেগ রোগীদের দেখতে এরকমই সাবধানতা নিতেন চিকিৎসকেরা। —ফাইল চিত্র।
চারদিন ধরে হেঁটে কাঁথি থেকে ঝাড়গ্রামে এসেছিলেন পাঁচজন খেতমজুর। ওড়িশা থেকে কিছুটা গাড়িতে, বাকি ৪৫ কিলোমিটার হেঁটে ঝাড়গ্রামের বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন ২১ জন পাতকুয়া শ্রমিক। একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা।
১২২ বছর আগে ফেরা যাক। ১৮৯৮ সালে প্লেগ মহামারি। ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকার প্রতিবেদন, ‘কলিকাতার লোকের আতঙ্ক ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সকলেই বৈভব দূরে ফেলিয়া পুত্রকন্যা সঙ্গে লহিয়া শহর ত্যাগ করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কী ধনী, কী নির্ধন, কী বৃদ্ধ, কী বালক, কী যুবক, কী যুবতী– সর্বসাধারণের সে আশঙ্কা, সে ভয়, সে ভাবনা সহজে বর্ণনা করা যায় না। কেহ রেলওয়ে স্টেশন অভিমুখে, কেহ স্টিমার ঘাটে, কেহ নৌকা সন্ধানে, কেহ গড়িতে, কেহ পদব্রজে- যে যেরূপে যেদিকে সুবিধা পাইল সে সেইরূপ সেইদিকে ছুটিতে লাগিল।...সহস্র সহস্র লোক ভাগীরথীর বক্ষে হাওড়া স্টেশন অভিমুখে ছুটতে লাগল। স্টেশনে দুই হাজার করিয়া লোক বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। টিকিট কিনিয়াও স্থান না পাইয়া সেদিন ৫০০ লোক ফিরিয়া আসিল। অবস্থা বুঝিয়া রেল কোম্পানি নিয়মিত ট্রেন ব্যাতীত অতিরিক্ত তিনখানি ট্রেনের বন্দোবস্ত করিলেন। সমস্ত ট্রেনই পরিপূর্ণ হইয়া গেল। শেষে মালগাড়িতে লোক লইতে বাধ্য হইলেন। স্টেশন হতে পোল পর্যন্ত লোকের ভিড়ে চলাফেরা বন্ধ হইয়াছিল। শেষে গাড়ি, পাল্কি, নৌকা মেলা ভার হইল। অনেক পুত্র-পরিবার লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া হাঁটিয়া পলাইতে আরম্ভ করিলেন’। তখন গুজব রটে যে কোয়ন্টাইন জারি হবে।
অতিমারি হয়ে দাঁড়ানো নোভেল করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে আশ্চর্য মিল শত বছর পুরনো মহামারির আতঙ্কের সঙ্গে।
মেদিনীপুরে পৌঁছে গিয়েছে নোভেল করোনাভাইরাস। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা তার আগে বহুবার মহামারির কবলে পড়েছে। লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় ১৮৬০ সাল থেকে। ওই বছর মেদিনীপুর জেল থেকে শহরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ১৪০ জনের মধ্যে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়। ১৮৬১ সালে মার্চে জেলে ১৫ জনের মধ্যে পাঁচজন মারা যায়। ১৮৬৩-৬৪ সালে আবার কলেরা মহামারি পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। শহরেও তার প্রভাব পড়ে। আবার জেলায় ১৮৬৬ সালে দু’বার কলেরা মহামারি হিসাবে দেখা দেয়। জেল হাসপাতালে ৪২ জন আক্রান্তের মধ্যে ২৩ জন মারা গিয়েছিলেন। মেদিনীপুর শহর এবং জেলার অন্য অংশে মহামারি ছাড়িয়ে পড়েছিল। এই সময় দুর্ভিক্ষও জেলায় চলছিল। ১৮৬৮-৬৯ সালে আবার কলেরা দেখা দেয়। তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে কলেরায় ১৬০৫ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১২৭৩ জনের মৃত্যু হয়। সিভিল সার্জেন কলেরা নিরাময়ের জন্য জেলের কয়েদিদের মাঝে মধ্যে স্থানান্তর করতেন। তাঁদের খাদ্যের তালিকাও পরিবর্তন করতেন।
কলেরা জেলায় ছড়িয়ে পড়ার জন্য পুরীতে জগন্নাথদেব দর্শনে যাওয়া তীর্থযাত্রীদের দায়ী করা হয়। কারণ জেলার মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা পুরীর দিকে গিয়েছে দেশের দূরদূরান্তের তীর্থযাত্রীরা সেই পথ ব্যবহার করতেন। তাঁরাই কলেরা রোগের জীবাণু বয়ে নিয়ে আসতেন বলে মত। তাঁদের পায়ের ক্ষত থেকেও বিভিন্ন সংক্রমণ হত। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় মেলাও ছিল বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর মাধ্যম। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে পুরী পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হওয়ায় বহু পুণ্যার্থী রেলগাড়িতে পুরী যেতেন। রেল সফরেও জেলায় রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্য মহামারি ছিল ১৮৬৬ সালের গুটি বসন্ত। এতে মৃত্যুর হিসেব জানা যায়নি। ১৯০২ সালে গুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাবে অবিভক্ত মেদিনীপুরে ১৭,৮৪১ জনের মৃত্যু হয়। গড়ে প্রতি মাইলে ৬.৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল বসন্ত রোগে।
অন্যদিকে বর্ধমান ও হুগলি জেলায় ১৮৬২-১৮৭৪ সালে এক ধরনের জ্বর দেখা দেয়। যা ‘বর্ধমানের জ্বর’ নামে পরিচিত। আসলে এক ধরনের ম্যালেরিয়া। এই জ্বরে মোট সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ মারা যান। বহুগ্রাম জনহীন হয়ে যায়। জন্মের হারেও বিশেষ বিঘ্ন ঘটে। ১৮৬২ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় বিভিন্ন জেলায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়। এই জ্বরের প্রভাব মেদিনীপুর জেলার উত্তর থেকে দক্ষিণে, সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কয়েক বছর জ্বরের দাপট থাকে। জ্বরে মেদিনীপুরে প্রায় দু’লক্ষ ৫০ হাজার বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছিল। ১৮৮১ সালে আবার মহামারি দেখা দেয় জেলার পূর্ব দিকে (তমলুক)। এবং তা দ্রুতই দক্ষিণ দিকে কাঁথিতে ছড়িয়ে পড়ে।
গবাদিপশুও মহামারির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ১৮৬৮ সালে প্লেগ মহামারি দেখা দেয়। তাতে তিন-চতুর্থাংশ গবাদিপশু মারা যায়। তবে শেষ দশকে কলেরা ও বসন্তরোগ মহামারি না হওয়ায় জেলাবাসী স্বস্তি পেয়েছিলেন।
‘বর্ধমান ফিভার’ ছাড়াও ম্যালেরিয়া মেদিনীপুরকে বারবার পর্যুদস্ত করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের বাঁধ এবং পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অংশে গাছ কাটার ফলে মেদিনীপুরে বিশেষ সমস্যা হয়। বন্যা থেকে বাঁচতে এবং নোনা জল বাধা দিয়ে হিজলির কয়েকশো বর্গমাইল ভূমি চাষের জন্য উদ্ধারও বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল। বাঁধে বন্যা আটকাল। কিন্তু তা জলনিকাশের পথও আটকে দিল। বদ্ধ জল ম্যালেরিয়ার মশার বংশ বাড়াল। যে অঞ্চলে বাঁধ বেশি, সেখানে ম্যালেরিয়াও বেশি। দক্ষিণ মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে পটাশপুর, ভগবানপুর ও খেজুরি থানা এলাকা জলে আবদ্ধ হতে শুরু করল। যা কৃষির ক্ষতির সঙ্গে ম্যালেরিয়া রোগের উৎস হিসেবে বহু জীবনহানি ঘটায়। ১৯১৮ সালে এক বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘জেলা যেন প্রাণহীণ, লোক ক্রমাগত কমেছে, আগের চাষযোগ্য জমি এখন জঙ্গলে পূর্ণ, গ্রামে বড় বড় অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ পূর্ব সমৃদ্ধির স্মৃতি বহন করেছে, রেশম ও বস্ত্রশিল্প লুপ্তপ্রায়, কাঁসারির সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে, সাধারণ লোকের মুখে উদাসীন নির্বিকার ভাবের ছাপ, এমনকি শিশুদের মধ্যে পর্যন্ত শিশুসুলভ চাঞ্চল্য ও কলরবের অভাব দেখা যায়’।
জ্বর, কলেরা, বসন্ত, বন্যা, ঝড় ও দুর্ভিক্ষ মেদিনীপুরের জনজীবনের বরাবরের প্রতিবন্ধক। সব বাধা কাটিয়ে উঠে ১৯২১ সালে জনবৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। তা ছিল ১৮৭২ সালের জনসংখ্যার শতকরা ৪.৮ বৃদ্ধি। ১৯২১-৫১, এই তিরিশ বছরে, বৃদ্ধি ১৯২১ সালের লোকসংখ্যার তুলনায় ২৬ শতাংশ। কাঁথি ও তমলুক মহকুমার মাটি বেশি উর্বর, জলনিকাশ ও জলসেচের ভাল ব্যবস্থা। তাই এই দুই মহকুমায় ক্রমাগত লোকবৃদ্ধি হয়েছে। উচ্চভূমিতে অবস্থিত পাথুরে ঝাড়গ্রাম মহকুমা (এখন জেলা) স্বাস্থ্যকর অঞ্চল। শুধু ১৯১১-২১ দশকে ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য বহু লোকের মৃত্যু ঘটেছিল এই এলাকায়। এই দশকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও কলেরা মহামারি হওয়ায় মেদিনীপুরের জনসংখ্যা ৫.৫ শতাংশ হ্রাস পায়। কাঁথি মহকুমার খেজুরি ও ভগবানপুর ছাড়া সব থানার জনসংখ্যা কমে।
১৯৩১-৪১ দশকে খড়্গপুরের রেল কারখানা তৈরির পরে লোকবৃদ্ধি হয়। এই সময়ে জেলায় বয়স্ক লোকের হার বর্ধমান জেলার থেকে কম এবং বীরভূম ও বাঁকুড়া থেকে বেশি। সম্ভবত ইনফ্লুয়েঞ্জা অপ্রাপ্তবয়স্ক অপেক্ষা বয়স্কদের পক্ষে বেশি মারাত্মক হয়েছিল। ১৯৪৩-৪৫ সালের দুর্ভিক্ষ ও মহামারির মিলিত প্রভাবে কাঁথি মহকুমার ভগবানপুর ছাড়া সবক’টি থানায় জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। এই সময় ঝড়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে বালিকা অপেক্ষা বালকের বেশি মৃত্যু হয়েছিল। বয়স্কদের ক্ষেত্রে পুরুষ অপেক্ষা নারীর মৃত্যু বেশি হয়।
তথ্যসূত্র: ১। ‘আমার দেশ’, অশোক মিত্র১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গের জনগণনা, ১৯৫৪, ২। ‘দ্য প্লেগ’, রাধাগোবিন্দ কর, সম্পাদনা সুবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়, ২০১১, ৩। মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, এল এস এস ও’ম্যালি। ৪। ‘এ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব মেদিনীপুর’ ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার, ১৯৯৭, ৫। বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, জে সি কে পিটারসন, ১৯১০।
লেখক প্রাবন্ধিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy