বে-পরোয়া: নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্র বিক্ষোভ, দিল্লি, ১৭ ডিসেম্বর। পিটিআই
গত ক’দিন ধরে ভারত সরকারের মর্মস্থলে একটা নতুন বার্তা পৌঁছচ্ছে। ক’দিন বললাম, ক’সপ্তাহ নয়। তার আগে অসমে, বাংলায় যে তাণ্ডব ঘটেছে, সেটা ভয়াবহ হলেও তা নেতা-শাসকদের চেনা গত; দমনে-কৌশলে তা সামাল দিতে, তার থেকে আখের গোছাতে তাঁরা সিদ্ধহস্ত। গত সপ্তাহে ছকটা হঠাৎ পাল্টে গেল। দেশ জুড়ে মানুষের ঢল রাস্তায় নামল। সেই প্রতিবাদের ভাষা-ভঙ্গি পরিচিত রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো নয়। রাজনৈতিক দলগুলির উপস্থিতি গৌণ হয়ে পড়ল। তাদের স্থান নিল স্থানীয় গোষ্ঠী, বা নিছক ব্যক্তি-নাগরিকের সমাবেশ। কোনও গূঢ় প্রেরণায় তারা একত্রে মিলেছে, সেটাই তাদের শক্তি। এটাই ভাল। রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত হলে, বা নানা দলের তরজার আখড়ায় পরিণত হলে, শক্তিটা হারিয়ে যাবে।
প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন সব বয়সের সব শ্রেণির মানুষ। ক্রাচে ভর দিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধা এসেছেন, রুজি বিসর্জন দিয়ে এসেছেন দিনমজুর। তবে অধিকাংশ জায়গায় বিশেষ ভাবে দেখা যাচ্ছে ছাত্রসমাজকে। দেশব্যাপী এই অভিব্যক্তির যদি কোনও সাধারণ লক্ষণ থাকে, তা হল ছাত্রদের উজ্জীবক ভূমিকা। আর যতই গুজব আর কুৎসা ছড়ানো হোক, যেখানে ছাত্রেরা পুরোভাগে থাকছে, মোটের উপর সেখানেই প্রতিবাদটা ধ্বংস-তাণ্ডব দূরে রেখে একটা অন্য সম্ভ্রম অর্জন করছে। ছাত্রেরাই বরং রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্যের শিকার হয়েছে।
আন্দোলনের মূল লক্ষ্য একটা অন্যায় আইন, যাতে ভারতীয় সমাজ দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে— একটা বৃহৎ সম্প্রদায় বিপর্যয়ের সম্মুখীন, বাদবাকিদেরও (বিশেষত গরিব ও অল্প শিক্ষিতদের) কপালে অশেষ হেনস্থা আর অনিশ্চয়তা। যে অশুভ রাষ্ট্রশক্তির প্রকোপে এটা হচ্ছে, তার একটা জ্বলজ্বলে প্রতিচ্ছবি দেখা গেল জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষায়তনে ছাত্রদের উপর আক্রমণে। দেশবাসীর কল্পনায় প্রবল নাড়া পড়ল। কখন কী পরিস্থিতি এ ভাবে অনুঘটকের কাজ করবে, হিসেব কষে বলা যায় না।
২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর যাদবপুরের পোর্টিকোয় তাণ্ডবকে এত দিন আমরা ছাত্রদের উপর রাষ্ট্রশক্তির সবচেয়ে প্রবল আক্রমণ বলে মেনেছি। জামিয়ার ঘটনা তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে; আরও বেশি ছাড়িয়েছে আলিগড় ও উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা। জামিয়ায় এক পাঠরত ছাত্রের চোখ নষ্ট হয়েছে; রক্ষণশীল চ্যানেলের ক্যামেরাও দেখিয়েছে গ্রন্থাগারের অলিন্দে চাপ চাপ রক্ত। আলিগড়ে দুই ছাত্রের হাত পুলিশের স্টান গ্রেনেডে উড়ে গিয়েছে, দু’জন আইসিইউতে, হাড় ভেঙেছে অন্যদের, মায় এক অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরও। অনেকে নিপীড়নের ভয়ে হাসপাতালে যায়নি, থানায় নির্যাতিত ও অপমানিত হয়েছে অনেকে।
অমিত শাহ উবাচ: গুরুতর প্রতিবাদ তো হয়েছে মাত্র চারটে বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাকিগুলোতে নেহাত গতানুগতিক আওয়াজ। মনে পড়ল কাশ্মীর সম্বন্ধে এক কর্তাব্যক্তির টিপ্পনী: কাশ্মীরিদের যদি অতই কষ্ট তো রাস্তায় নামছে না কেন? এ তো শাঁখের করাত— ‘আসল’ প্রতিবাদ অর্থাৎ হিংসা হানাহানিকে দমন করা হবে (করাই উচিত), আবার শান্তিপূর্ণ সমালোচনা ধর্তব্যে আনা হবে না।
উত্তরপ্রদেশের নৃশংসতার যথেষ্ট প্রচার ও নিন্দা এখনও হয়নি। তবু দেশ জুড়ে ছাত্রগোষ্ঠীর মধ্যে একটা সুপ্ত একাত্মতা দেখা যাচ্ছে, বৃহত্তর সমাজও একটা নাড়ির টান বোধ করছে। ছাত্রদের দলে কেবল জেএনইউ-যাদবপুরের ‘মার্কামারা’রা নেই, ‘ভব্য শান্ত’ বিদ্যাচর্চার পীঠস্থানের পড়ুয়ারা— আইআইটি, আইআইএম, মায় আইআইএসসি, মহার্ঘ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, আরও অনেক সদা নিস্তরঙ্গ শিক্ষাপ্রাঙ্গণের ছেলেমেয়েরাও আছে।
সাধারণ দৃষ্টিতে সব ছাত্র-আন্দোলনের একটাই বেয়াড়া চরিত্র। আসলে কিন্তু তা দু’রকমের। বেশির ভাগ অশান্তি হয় কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায়, সেই দলের অর্থবল ও পেশিশক্তির সেবায়। ব্যাপারটা তুঙ্গে ওঠে ইউনিয়ন নির্বাচনের সময়; কিন্তু বাকি বছরটাও কর্তৃপক্ষ, সাধারণ ছাত্র, এমনকি গোটা এলাকা তটস্থ থাকে। অনুমিত ভাবেই, দলনির্বিশেষে নেতৃকুল এই বন্ধ্যা হিংসা-অনাচারের পরম সমর্থক ও প্রশ্রয়দাতা। সেই নেতারা যখন নিদান দেন যে ছাত্রসমাজ রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে (যেমন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী আজ বলছেন), বা ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করবে দলবিহীন কাউন্সিল (যা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর ইচ্ছা), তাঁদের দ্বিচারিতায় হতবাক হতে হয়।
নেতাদের চক্ষুশূল— অল্পসংখ্যক ভিন্ন চরিত্রের কিছু প্রতিষ্ঠান, যেখানে রাজনীতির বিলক্ষণ উপস্থিতি, এমনকি উৎকট প্রকাশ ঘটে, কিন্তু সেটা প্রচলিত দলীয় রাজনীতি নয়। আর কী আশ্চর্য, এই জায়গাগুলি সচরাচর হয় দেশের প্রথম সারির বিদ্যায়তন। এদের আন্দোলনের চিন্তাটা প্রায়ই অন্য রকম, মোকাবিলাও তাই অন্য ভাবে করতে হয়।
এই নিয়ে সেন্টিমেন্টাল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সারা জীবন এমন দু’টি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছি; বিলক্ষণ জানি সেখানকার আন্দোলন কত অবুঝ, অসার, উদ্ধত ও সময়ে-সময়ে মারমুখী হতে পারে। ছাত্রদের সঙ্গে বহু বাক্বিতণ্ডায় জড়িয়েছি। তাতে অনুতপ্ত নই; কর্মজীবন ফিরে পেলে আবার একই ভাবে জড়াতাম, কারণ অবুঝ আন্দোলনে ছাত্রদেরও ক্ষতি, প্রতিষ্ঠানেরও। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা জিনিস বুঝেছি। এই গোত্রের আন্দোলনের পিছনে থাকে একটা যুক্তি, একটা বোধগম্য মানসিকতা, হয়তো কোনও যথার্থ ক্ষোভ-ক্ষতি (যা আন্দোলনের ঘোষিত কারণ না-ই হতে পারে)। তার মোকাবিলা করতে দরকার পাল্টা যুক্তি, কোনও-না-কোনও স্তরে একটা মানসিক আদানপ্রদান বা মেলবন্ধন। কর্তৃত্ব ফলাতে গেলে, শাস্তি বিধান করলে, পুলিশ ডাকলে অশান্তি মিটবে না। লেখাপড়া আরও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে— অবিশ্বাস্য আনাড়ি পরিচালনার ফলে জেএনইউ-এর আজ যে দশা। ছাত্রদের অবস্থানকে সম্মান দিলে কিন্তু সচরাচর (সর্বদা বলছি না) পাল্টা সম্মান পাওয়া যায়। আবার বলছি, পরম মেধাবী ছাত্রদেরও বয়সোচিত ভুল বা অজ্ঞতা তো বটেই, জেদ হিংসা নষ্টামিও কিছু কম নেই। কিন্তু তার মধ্য দিয়েই তারা যে প্রশ্নগুলি তোলে, তার যথাযোগ্য বিচার না করলে বয়স্কেরা কর্তব্যচ্যুত হবে। খতিয়ে দেখলে প্রায়ই উঠে আসে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে কোনও ভুল, অনাচার বা সত্যিকারের অপরাধ, যার পাপের মাত্রা নিছক ‘ইনডিসিপ্লিন’-এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। সেটা স্বীকার করে প্রতিকারের চেষ্টা করলে ছাত্রদের দাবির মোকাবিলাও সহজ হয়ে পড়ে। এই পন্থার উপযুক্ত বিচারবোধ, ধৈর্য ও সততা কর্তৃপক্ষের প্রায়ই থাকে না; রাষ্ট্রের কর্ণধারদের তো থাকেই না।
আজ এই বেয়াড়া বুদ্ধিমান তরুণেরা অভূতপূর্ব সংখ্যায় রোখ চেপে রাস্তায় নেমেছে, শাসকের বাঁধা বুলির আড়ালে (ঠিক বাঁধাও নয়, নিত্য পাল্টাচ্ছে) যে অবিচার আর তঞ্চকতা তা প্রত্যাখ্যান করছে। সত্যাগ্রহীদের মুখোমুখি ব্রিটিশ রাজের মতো আজকের রাজপুরুষেরা তাই কেমন বিহ্বল। বোমা-গুলি-আগুন-ভাঙচুর তাঁদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের অঙ্গ; কিন্তু রাস্তার মোড়ে সংবিধান পাঠ বা পুলিশকে গোলাপ বিতরণ— এ সব কোন দেশি আদিখ্যেতা? ঠেঙানো-খেদানো অবশ্যই যায়, সুযোগ পেলেই করা হচ্ছে; কিন্তু সুযোগটাই যেন এরা দেয় না, দিলেও তা নিয়ে বড্ড শোরগোল ওঠে। এ দিকে এদের কুসঙ্গে পড়ে গরিবগুর্বোরাও মাথায় উঠছে।
এমনটা বেশি দিন চলতে পারে না। ছাত্রেরা, অন্তত এই ছাত্রেরা এই ময়দানে আনাড়ি খেলোয়াড়— সেটা এক দিকে তাদের জোর, অন্য দিকে দুর্বলতা। নির্দয় পোড়খাওয়া রাজনৈতিক কুশীলবদের সঙ্গে এরা কত দিন পাঞ্জা কষবে? প্যারিসের ছাত্র-জাগরণ থেকে আরব বসন্ত, কোনওটা কোনও স্থায়ী পরিবর্তন এনেছে কি? প্রায়ই বরং উল্টো ফল হয়েছে, আরব দুনিয়ায় যেমন দমনপীড়ন স্বৈরাচার প্রচণ্ড বেড়েছে। ভারতেও হতে কত ক্ষণ? দেশের আজকের আবহ দশ বছর আগে কল্পনাতীত ছিল। তবে গত দুই সপ্তাহে যে উল্টো হাওয়া বইছে, সেটাও কি ভাবতে পেরেছিলাম? সে প্রাপ্তিটুকুও আঁকড়ে থাকার মতো। তার কৃতিত্ব অনেকটা এই বেপরোয়া ছেলেমেয়েগুলোর।
ওরা আরও বলুক, আরও ভাবুক, আরও শিখুক ও শেখাক। ওদের জয় হোক।
লেখক: এমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy