ছবি পিটিআই।
রাজ্য নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়া জাতীয় রাজনীতির হাওয়া বুঝিবার চেষ্টা বিচক্ষণতার পরিচায়ক নহে। তাহার প্রয়োজনও নাই। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা নির্বাচনের প্রচারপর্ব এবং ফলাফলে ইঙ্গিত রহিয়াছে, রাজনীতি চরিত্রে সম্ভবত ফের ‘স্থানীয়’ হইতেছে— রাজ্য-রাজনীতির সুর আর শুধু কেন্দ্রীয় প্রশ্নের তারে বাঁধা মুশকিল। সর্বভারতীয় প্রশ্নের তুলনায় সম্ভবত স্থানীয় সুশাসন ও অর্থনীতির প্রশ্নের রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িতেছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি এবং এনসিপি-র প্রচারের তুলনা করিলে কথাটি স্পষ্ট হইবে। বিজেপির প্রচারের কেন্দ্রে ছিল সর্বভারতীয়— মূলত অতিজাতীয়তাবাদী প্রশ্ন। যেমন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি, অথবা পাকিস্তানের সহিত সীমান্ত-সম্পর্ক ইত্যাদি। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী মহারাষ্ট্রে প্রচারে গিয়া নামোল্লেখ না করিয়াই শরদ পওয়ারকে আক্রমণ করিয়াছিলেন ৩৭০ ধারার প্রসঙ্গ তুলিয়া। অন্য দিকে, এনসিপি-নেতৃত্ব সমানেই মানুষের হরেক দুর্দশার কথা বলিয়া গিয়াছেন। হরিয়ানাতেও যেমন বিরোধী প্রচারের কেন্দ্রে বার বার শাসনের অভাবের প্রসঙ্গ আসিয়াছে। গত ছয় বৎসরে সম্ভবত এই প্রথম বার বিরোধীদের আক্রমণের কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী ছিলেন না— ছিল বিজেপির শাসনে মানুষের মন্দ অবস্থার কথা। এক অর্থে, নরেন্দ্র মোদীর উত্থানের পর এই প্রথম একটি নির্বাচন তাঁহার বা তাঁহাদের বাঁধিয়া দেওয়া সুরকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হইল না।
লক্ষণীয়, দুই রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী শিবিরের দুই প্রধান মুখ, যথাক্রমে শরদ পওয়ার এবং ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা, গত কয়েক মাসের সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত প্রশ্ন ৩৭০ ধারা বিলোপ লইয়া কখনও কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানের কট্টর বিরোধিতা করেন নাই। বস্তুত, হুডা দলের ‘হাই কমান্ড’কে অমান্য করিয়া তাহাকে সমর্থন করিয়াছেন। ইহা কি রাজনৈতিক পরিণতমনস্কতার পরিচায়ক নহে? কারণ প্রশ্নটি এক বার নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রে আসিলে সর্বাধিক লাভ যে নরেন্দ্র মোদীদের হইত, তাহা সংশয়াতীত। বরং, উগ্র জাতীয়তাবাদকে আলোচনার বাহিরে রাখিয়া অর্থনীতি ও সুশাসনের প্রশ্নগুলিকে বারে বারে ফিরাইয়া আনিলে বিজেপির দুর্বলতম জায়গায় আঘাত করা যায়। বিশেষত পওয়ার ঠিক সেই কাজটিই করিয়াছেন। নির্বাচনী ফলাফল সম্ভবত বিল ক্লিন্টনের সুরে সুর মিলাইয়া বলিল, ইট’স দি ইকনমি, স্টুপিড। অর্থনীতির ভগ্নস্বাস্থ্য মানুষের মনে যে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত করিয়াছে, তাহাকে ব্যবহার করাই বিরোধী রাজনীতির কাজ ছিল। আংশিক ভাবে হইলেও দুই রাজ্যেই তাহা সম্ভব হইয়াছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি জয়ী, হরিয়ানাতেও শেষ পর্যন্ত হয়তো তাহারাই সরকার গড়িবে। কিন্তু, মোদী-শাহের বিজয়রথের চাকা যে খানিক হইলেও বসিল, তাহা অনস্বীকার্য। বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
রাহুল গাঁধীরা ভোটারদের কথা শুনিলেন কি না, সেই উত্তর এখনও অজ্ঞাত। মানুষের রায় স্পষ্ট— বিরোধীদের বিরোধীসুলভ রাজনীতি করিতে হইবে। সরকারের বাঁধিয়া দেওয়া সুরে গত বাঁধিলে চলিবে না, নিজেদের প্রশ্ন তুলিয়া আনিতে হইবে। নরেন্দ্র মোদীর তুল্য কোনও নেতা না থাকিলে বিজেপির সহিত টক্কর দেওয়া অসম্ভব, এই কথাটি যে সম্পূর্ণ ঠিক নহে, তাহা বোঝা গেল। মহারাষ্ট্র কংগ্রেস বা এনসিপি যে ভোট পাইয়াছে, তাহা কোনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতার কল্যাণে নহে— মানুষের ক্ষোভকে ব্যবহার করা সম্ভব হইয়াছে বলিয়াই ভোট মিলিয়াছে। প্রশ্ন হইল, নিজেদের স্থিতিজাড্য ত্যাগ করিয়া বিরোধীসুলভ রাজনীতি করিবার মতো মনের জোর নেতারা জোগাড় করিতে পারিবেন কি? অর্থনীতির ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া সরব হইতে পারিবেন কি? মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা জানাইয়া দিল, পারিলে রাজনীতির নূতন গতিপথ রচনা করা এখনও সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy