Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Indian Democracy

আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ভারতের গণতন্ত্র সূচকের পতন অশনিসঙ্কেত

সংকীর্ণ রাজনীতির তাণ্ডবে অর্থ হারাচ্ছে বৃহত্তম গণতন্ত্রের মহিমা। বিশ্বের চোখে তা স্পষ্ট ভাবে ধরাও পড়ছে। লিখছেন শৌভিক রায় সংকীর্ণ রাজনীতির তাণ্ডবে অর্থ হারাচ্ছে বৃহত্তম গণতন্ত্রের মহিমা। বিশ্বের চোখে তা স্পষ্ট ভাবে ধরাও পড়ছে। লিখছেন শৌভিক রায়

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২০ ০৪:০৫
Share: Save:

আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় ভারতের গণতন্ত্রের সূচক এক ধাক্কায় ১০ ধাপ নীচে নেমে এসেছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কাজকর্ম, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ ও স্বাধীনতা, রাজনীতি মনস্কতা এবং নাগরিক স্বাধীনতার ইপর ভিত্তি করে চালানো সমীক্ষার এই ফল ভারতীয় গণতন্ত্রের কাছে অশনিসঙ্কেত। গণতন্ত্রের সূচক নেমে যাওয়ার অর্থ, আন্তর্জাতিক স্তরে খানিকটা হলেও ভারতের সুনামহানি হওয়া এবং তার প্রভাব পড়বে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে।

ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা তর্ক-বিতর্ক চলে এসেছে। ছাপা ব্যালট বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সেই বিতর্ক নিরসনে কোনও কাজে আসেনি। প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে। এমনিতেই ভারতের মতো দেশে, যেখানে নিরক্ষরতা এখনও অভিশাপ, সেখানে দারিদ্র ও অশিক্ষা ভোট কেনার সহায়ক। রাজনৈতিক দলগুলি এখানে ‘ভোট করায়’। তাই নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্ভুল হবে, এমন ভাবাটা মস্ত ভুল। রিগিং, বুথ দখল, বুথ জ্যাম, ভোট দিতে না দেওয়া ইত্যাদি তো এই দেশের নির্বাচনের চেনা চিত্র। বহুত্ববাদের দেশ হলেও নিজের এলাকায় দখলদারি কায়েম রাখতে প্রয়োজনে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নামতেও কাউকে দ্বিধা বোধ করতে দেখা যায় না! এক পক্ষের অন্য পক্ষকে ন্যূনতম সম্মান না দেওয়াটাই রেওয়াজ। যেনতেনপ্রকারে নিজেরটি প্রমাণ করতে পারলেই যেখানে মোক্ষলাভ হয়, সেখানে বহুত্ববাদের আর কদর কী! জোর যার মূলক তার গোছের প্রাগৈতিহাসিক নীতি রাজনৈতিক বহুত্ববাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বাধীনতার এত বছর পরেও বিরোধীশূন্য করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলি যতটা যত্নশীল, তার সিকিভাগও যদি তারা দেশের কল্যাণে ব্যয় করত, তবে হয়তো এই দিন দেখতে হত না!

সরকারের কাজকর্ম নিয়ে যত কম বলা যায়, তত ভাল। যে সরকারের একের পর এক পদক্ষেপ দেশের সুস্থিতি নষ্ট করার কারণ, সেই সরকার তা হলে কাজের কাজ কী করছে, তা বোঝা বিশেষ শক্ত নয়। দেশের মানুষকে নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা অত্যন্ত সুচতুর ভাবে করা হচ্ছে, তাতে নিজেদের হতভাগা ছাড়া আজ আর কিছু মনে হয় না! সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা মানেই এখন দেশদ্রোহীর তকমা লাগা। রাষ্ট্রের কল্যাণকামী যে রূপ সরকারের কাজের মধ্য দিয়ে মূর্ত হওয়ার কথা, তা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। উল্টে এই মুহূর্তে নখ-দাঁত বার করা এমন এক রাষ্ট্র আমাদের সামনে বর্তমান, যে প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যস্ত রাখছে দেশের মূল সমস্যাগুলি দূরে সরিয়ে রাখতে। চুলোয় গিয়েছে আর্থিক বৃদ্ধি, দারিদ্র কিংবা কাশ্মীর নিয়ে তথ্য জানার মতো বিভিন্ন বিষয়। নাগরিকেরা নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হওয়ার ভয়ে স্বন্তস্ত্র। সভ্য কোনও রাষ্ট্রে এমন হয়েছে কি না, মনে করা বেশ কঠিন!

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ ও স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ ভাবে খাতায়-কলমে বন্ধ না হলেও পরোক্ষ ভাবে যথেষ্টই প্রভাবিত। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভরসা করা হচ্ছে পেশিশক্তির উপর। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা সেটিই প্রমাণ করছে। এ ক্ষেত্রে দেশের নাম উজ্জ্বল করা নাগরিকদেরও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। যেখানে পেশির আস্ফালন সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে অত্যন্ত কদর্য ভাষায় এমন আক্রমণ শুরু হয়েছে, যা কল্পনাতীত। কন্ঠস্বর বিরোধী হলেই যে ভাবে একজন সেই ব্যক্তিকে এমন অবস্থার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে যে, যেখান থেকে তাঁর পরিত্রাণ পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সামাজিক স্তরে অশ্লীল ‘ট্রোল’। এই অদৃশ্য দাদাগিরি ও নোংরামির হাত থেকে কবে যে আমরা মুক্ত হব, তা বলা কঠিন! আমাদের স্বাধীনতা আজ সত্যি ভুলুণ্ঠিত আর তাতে তাণ্ডবনৃত্য করছে পদলেহন, চাটুকারিতা ও অন্যের সঙ্গে অভব্যতা।

রাজনৈতিক মনস্কতা ব্যাপারটি আমাদের কবে আর কতটা ছিল, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ জাগে। যে দেশের অধিকাংশ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাঁদের রাজনীতি নিয়ে ভাবার অবকাশটা কোথায়! দারিদ্রের সঙ্গে নিরক্ষরতা ও অশিক্ষা যোগ হয়ে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। আর যুগে যুগে এই সুযোগটিই নিয়েছে রাজনীতির কারবারিরা। কেননা, তারা জানে যে, এই দু’টি সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সবচেয়ে বড় বিপদ হবে তাদের নিজেদের। সুতরাং এই সমস্যাগুলি জিইয়ে রেখে দিনের পর দিন রাজনৈতিক দিক থেকে তারা আমাদের চোখে ঠুলি পড়িয়ে রাখছে। উদার রাজনীতিমনস্ক জনগণ যা করতে পারে, আমরা সেটা করতে পারছি না। বরং তাদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছি। কখনও জেনেবুঝে, কখনও অজ্ঞাতে। তা না হলে যে দেশের মানুষকে শুখা মরসুমে জলের জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়, সে দেশে ধর্ম বা জাতপাত নিয়ে এই উন্মাদনার সৃষ্টি হয় কী ভাবে?

শেষ বিষয়টি হল নাগরিক স্বাধীনতা। রুশোর সেই বিখ্যাত কথাটি বোধ হয় আজও প্রণিধানযোগ্য— ‘জন্ম থেকে আমরা মুক্ত, কিন্তু সর্বত্রই শৃঙ্খলিত’। মুক্ত বা স্বাধীন বলতে অবশ্যই এমন কিছু বোঝায় না, যা অন্যের ব্যক্তিপরিসরকে নষ্ট করে। স্বাধীনতার নামে এমন কিছুও আশা করা যায় না, যা সমাজ বা দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক।

এ সব মাথায় রেখেও অস্বীকার করা যায় না যে, দিনদিন নাগরিক স্বাধীনতা অলীক স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। যে ভাবে পিছিয়ে পড়া এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, তা একবিংশ শতকের বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে অভিপ্রেত নয়। আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় যে, অনেক ক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রের মদতে করা হচ্ছে। অতীতে এমনটি হয়নি, তা নয়। কিন্তু তা যেন না হয়, সে দিকে লক্ষ রেখেই নতুন দিন আসে। কিন্তু সেই নতুন দিন যদি শুভবার্তার বাহক না হয়, তবে নিজেদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। আজ বোধ হয় দেশ সেরকমই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।

তবু হাল ছাড়া কাম্য নয়। উচিতও নয়। অতীতেও ভারতীয় গণতন্ত্রকে বহুবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সে সব সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও এ বারের সঙ্কট অনেক গভীরে। টালমাটাল এই দশায় আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের হাত শক্ত করা উচিত। তা না হলে বিপদ আমাদেরই। কারণ, এই মহান গণতন্ত্রের আমরাই ধারক এবং বাহক। মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দায়ভার আমাদের নিজেদের কাছেই আর সে দায়ভার পালন করতে না পারলে আমরা নিজেরা নিজেদের কাছেই ছোট হয়ে যাব।

(লেখক কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Democracy Survey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy