আগেই শুরু হয়েছিল প্রক্রিয়াটা, ভোটবাদ্য বেজে ওঠায় হুড়োহুড়ির মাত্রাটা প্রত্যাশিত ভাবেই বেড়ে গেল। বুদ্ধিজীবী সেল-এ নিয়োগ-পর্ব এখন পুরোদমে। তার কিছুটা ‘ওপেন’, আর অনেকখানি ‘গোপেন’। অনেক তারাই দেদীপ্যমান দিনের আলোর গভীরে। কিয়ৎ সাবধানি নীরবতা, কিয়ৎ জল মাপার তৎপরতা, কিয়ৎ ব্যঞ্জনাবহুল বার্তা বিনিময়। ইতিহাসের বই খুলে দাগিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠাগুলো— লাগসই উদ্ধৃতির কমতি যেন না পড়ে। কোলাহল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার চোখে চোখ রাখার কথা ছিল যাঁদের, আজকাল কোলাহল উৎপাদন করার কাজেই তাঁদের সবচেয়ে বেশি ডাক পড়ে। তাঁরাও হৃষ্টচিত্তে পঙ্ক্তিভোজনে বসে যান।
প্রচারের আলোর টান, সরকারি দাক্ষিণ্যের লোভ, মতাদর্শের নামে বাঁধা বুলি আওড়ানোর অভ্যাস করায়ত্ত ছিল অনেক কালই। সত্য-উত্তর যুগে আড়েবহরে বেড়ে এ সবই আরও দৃঢ়সংবদ্ধ হয়েছে। হতে হয়েছে। পত্রপত্রিকায় কলম ধরার সাবেক রীতির পাশাপাশি টিভি চ্যানেলে মুখ দেখানো, সোশ্যাল মিডিয়ায় গলা ফাটানো, সভা-সমাবেশে হাজিরা দিয়ে নিজস্বী তোলা, প্রয়োজনমাফিক আইটি সেল-এর উপদেষ্টার দায়িত্ব সামলানো, এ-সব প্রাত্যহিক প্রয়োজনের ঘনঘটা বহুলাংশে নব্য প্রযুক্তির উপজাত, ফলে চাহিদা জোগানের অঙ্ক মেনে রাজনৈতিক দলগুলির নিজস্ব ভাবুক সভার কলেবর বৃদ্ধি ঘটেছে। সেই সঙ্গে রাজনীতির ভাগ্যলক্ষ্মী এমন অনেককেই কৃপা করেছেন, যাঁদের দরবারে ‘বুদ্ধিজীবী’ কিঞ্চিৎ কম পড়িয়াছিল। অতএব একাধারে নতুন মুখের ভিড় আর চালকলার টানে শিবির বদলের ঝোঁক, এই দুই প্রবণতার পালেই হাওয়া বয় শনশন। যোগফল? অদূর অতীতে যা ছিল ‘ঘনিষ্ঠ বৃত্ত’, আজ তা ‘বুদ্ধিজীবী বাহিনী’তে পরিণত।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এতে আপত্তি কোথায়? দলীয় রাজনীতির সঙ্গে ইন্টেলেকচুয়ালের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায় হতে হবে, এমন কোনও মাথার দিব্যি আছে কি? উত্তরে হ্যাঁ এবং না, দুটোই বলা ছাড়া গতি নেই। না, এই অর্থে— যে কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শেরই একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকে। সেখানে ইন্টেলেকচুয়ালের সঙ্গেই তার নাড়ির যোগ। আবার রাজনীতির দৈনন্দিনতার বৃত্তেও বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা বরাবরই বিদ্যমান। রাজার সভাকবি থেকে শুরু করে সরকারি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক, তাঁদের নিয়েই তৈরি।
এ বার হ্যাঁ-বাচক উত্তরটি খুঁজতে হলে তাকাতে হবে এই বৃত্তের বাইরে, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের দিকে। পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল কে? যিনি জগৎসংসারের প্রতি নির্লিপ্ত গজদন্তমিনারবাসী নন, যিনি তাঁর যুগের পরিস্রুত স্বরকে স্বকণ্ঠে ধারণ করেন। এডওয়ার্ড সইদকে ধার করে বলা চলে, তাঁর বার্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, দর্শন এবং যুক্তি একই সঙ্গে জনগণের হয়ে এবং জনগণের উদ্দেশে গঠিত এবং বিবৃত। অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলা, গোঁড়ামি এবং বদ্ধমূলের প্রতিরোধ করাই তাঁর কাজ। সরকার বা প্রতিষ্ঠান তাঁকে কখনওই আত্মসাৎ করতে পারে না।
ধোঁয়াশার কোনও জায়গা নেই এই সংজ্ঞায়। ব্যবহারিক বুদ্ধিজীবী নন, প্রকৃত প্রস্তাবে চিন্তানায়ক যিনি হন, স্বধর্মেই তাঁকে হতে হয় শিবিরের বেড়াজালমুক্ত। বাধ্যবাধকতার বাঁধনহীন। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তোল্লাই দেওয়া বা রেয়াত করার দায় তাঁর থাকে না। ঘরের লোক হয়ে উঠবার তাগিদ তিনি অনুভব করেন না। এ কালের সঙ্কট এই যে, ‘সেল’ বা বাহিনীর রমরমা এখানে স্বাধীন চিন্তানায়কের এই ধারণাটিকেই প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। দিগ্ভ্রষ্ট পথিককে দিশা দেখানোর মতো বাতিঘর এমনিতেই আজ বিলুপ্তপ্রায়। তদুপরি বুদ্ধিজীবী নামধারী পারিষদবর্গের ঐকান্তিক চেষ্টাই এই, যাতে বাহিনী-বহির্ভূত কোনও স্বর তার অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখতে না পারে। তাতে শুধু যাবতীয় বিরোধিতা মুছে ফেলার সুবিধাই হয় না, বাহিনীর বাইরে থাকার ব্যবস্থাটাই নষ্ট করে দিয়ে এক নিউ-নর্মাল ঘরানা প্রতিষ্ঠা করা যায়, যেখানে আত্মীকৃত বুদ্ধিজীবীকেই নিরপেক্ষ ভাবুক বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। অভিসন্ধিই হবে চিন্তনের একমাত্র চালিকাশক্তি।
অথচ, এ কথা কে না জানে, এক জন চিন্তক তত ক্ষণই স্বাধীন ও স্বচ্ছ, যত ক্ষণ তিনি নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠীতে নাম লেখাননি। শাসক বা বিরোধী, কারওরই কোলে ঝোল টানার ব্যস্ততা তাঁর নেই। কোনও মতাদর্শের প্রতি তাঁর বিশ্বাস থাকতে পারে, কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর নৈকট্য থাকতে পারে, তিনি কোনও না কোনও প্রতিষ্ঠানের অংশও হতে পারেন। কিন্তু এর কোনওটিই তাঁর ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে না, তাঁর সত্তাকে মুঠোয় পুরে ফেলে না। চিন্তাকে যদি হতে হয় স্বরাট, দূরসঞ্চারী এবং মেঘমুক্ত, তা হলে এক ধরনের স্বভাবজ স্বাতন্ত্র্য তার অনিবার্য পূর্বশর্ত। চিন্তানায়ক তিনিই, যিনি মানুষের স্বার্থে কথা বলেন, কিন্তু জনতার কলরোলে একাকার হন না। তাঁর স্থান ঝাঁকের বাইরে, স্রোতের বিপরীতে। তাঁর বিবৃতি সময়বিশেষে কোনও রাজনৈতিক-সামাজিক গোষ্ঠীর পক্ষে বা বিপক্ষে যায় বা যায় না, কিন্তু তিনি কদাপি কারও মুখপাত্র নন। তিনি যদি কোনও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তা যুক্তির কষ্টিপাথর, নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ বলেই। স্বার্থে নয়, ভাবাবেগে নয়, ভয়ে বা মোহে নয়, তাৎক্ষণিকতায় নয়। তাই বলে মানুষী দুর্বলতা, স্খলন, ক্ষুদ্রতা কি তাঁর নেই? থাকতেই পারে। কিন্তু যেখানে বীক্ষার গভীরতার প্রশ্ন, চিন্তার শুদ্ধতার প্রশ্ন, ভাবনার সততার প্রশ্ন, সেখানে তিনি অজেয়। হাততালি বা চুনকালি, কিছুরই পরোয়া না করে তিনি থেকে যান নিষ্কম্প, বলে যান যা তাঁর বলে যাওয়ার ছিল।
আকাশকুসুম কল্পনা নয় এ সব। সোক্রাতেস থেকে সলঝিনেৎসিন, পেরিয়ে এসেছেন এই অন্তবিহীন পথ। শুধু প্রাতিষ্ঠানিকতার পাশমুক্ত থাকতে চান বলে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন জাঁ পল সার্ত্র। পারিপার্শ্বিকতার প্রতি সতত সজাগ এবং দায়িত্বশীল থেকেই স্বতন্ত্র যাপনে অবিচল ছিলেন সত্যজিৎ রায়। সরকারি কমিটির হাতছানি পারতপক্ষে এড়িয়ে গিয়েছেন অমর্ত্য সেন। বহুচর্চিতের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়েও ফিরে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথকে— সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে পক্ষ নিয়েছেন বার বার, কিন্তু শিবিরভুক্ত হননি। একা পড়ে যাওয়ার ভয় তাঁকে অপ্রিয় ভাষণে বিরত করেনি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে নিজে রাস্তায় নেমেছেন। নিজেই পরে ঘরে বাইরে লিখেছেন। ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’র মতো গান বেঁধেছেন, আবার দেশমাতৃকার আরাধনার নামে বাস্তববর্জিত এবং আগ্রাসী দেশপ্রেমের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন। গাঁধীকে মহাত্মা বলে ডেকেছেন, কিন্তু মতের ভিন্নতাকে বর্জন করেননি। তাঁর অন্তর যাকে সত্য বলে মেনেছে, শুধু তারই প্রতি প্রণত থেকেছেন আজীবন।
এখন সব অলীক?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy