অস্ট্রেলিয়ার মানুষ ক্লাইভ হ্যামিলটন চিন বিশেষজ্ঞ। আর মারাইকে অলবর্গ বাস করেন বার্লিনে, জার্মান মার্শাল ফান্ডের এশিয়া কর্মধারার বরিষ্ঠ ফেলো। এঁদের যৌথ প্রয়াসে রচিত চিনের আন্তর্জাতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত একটি বই পড়লাম সম্প্রতি। ইতিহাসচেতনার বিচারে বইটি নিতান্ত অ্যামেচার গোত্রের, ফলে জন লে কারের স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড পড়ে যাঁদের দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধোত্তর ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ সম্পর্কে উৎসাহ হয়েছে, চিনা ড্রাগনের দাঁতনখ বিস্তারের সাম্প্রতিক পদ্ধতি থেকে তাঁরা তেমন রসানুভূতি প্রত্যাশা করলে নিরাশ হবেন। শক্তির লড়াইয়ের সেই সব রোম্যান্টিক দিন আর হয়তো ফিরে আসবে না।
আসলে, হিডন হ্যান্ড নামে এই বইটি গত সাত-আট বছরে শিং জিয়াওপিং-এর নেতৃত্বে বিশ্বশক্তি হিসেবে পৃথিবীর মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার পর আমেরিকান গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চিনের গোপন লড়াইয়ের এমন একটা বিবরণ দেয়, যেটা থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার ও বোঝার আছে। প্রথমেই বলতে হয়, বিশ্বরাজনীতির ক্রমবর্ধমান চিন-কেন্দ্রিকতার কথা। যাঁরা ভারত থেকে চিনকে দেখেন, ভাবেন সে কেবল এক নতুন বড়লোক প্রতিবেশী, তাঁরা হয়তো জানেন না কত বিস্তৃত চিনের বর্তমান লড়াইয়ের মঞ্চ। সেখানে ভারতের ভূমিকা খুবই অকিঞ্চিৎকর। এই এক নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ, যেখানে পশ্চিমি গোষ্ঠী মুখোমুখি হয়েছে এমন এক শক্তির, যার সামরিক ও অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন। সোভিয়েট ইউনিয়ন অবশ্যই ছিল বিশ্বশক্তি, কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র ও মহাকাশ-বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি সত্ত্বেও সে ছিল অর্থনৈতিক (এবং সাংস্কৃতিক) দৌড়ে আমেরিকার থেকে অনেক পিছিয়ে। এ কথা অবশ্যই সত্য যে, পশ্চিমি দুনিয়া কোনও দিন চিনের মতো এমন এক বিরুদ্ধ শক্তির সম্মুখীন হয়নি, যে করায়ত্ত করেছে পৃথিবীর প্রায় সমগ্র ফ্যাক্টরি উৎপাদন। এবং উন্নত প্রযুক্তিতেও যে অামেরিকার থেকে খুব পিছিয়ে নেই।
চমকে যেতে হয় খাস ওয়াশিংটন শহরের প্রায় সব শক্তিকেন্দ্রে চিনের পদচিহ্নের বিবরণ পড়ে। ১৯৯৬ সালে এক বার খুব হট্টগোল হয়েছিল যখন চিনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) থেকে প্রেরিত এক গোয়েন্দাকে দেখা গেল বিল ক্লিন্টনের নির্বাচনী তহবিলে মোটা চাঁদা দিয়ে নিয়মিত সাক্ষাতের ব্যবস্থা পাকা করে নিতে। আজকের চিন কিন্তু আর সে কালের মতো অনভিজ্ঞ খেলোয়াড় নয়— ওয়াশিংটনের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সিপিসি-র ‘দূত’-দের সম্পর্কের গভীরতাটি লক্ষ করলে বোঝা যায়। ওবামার কালে (২০০৮-১৬) তা সবচেয়ে বাড়ে, যখন আমেরিকান নেতারা প্রায় সকলেই ধরে নেন যে, চিনের ‘পিসফুল রাইজ়’— শান্তিপূর্ণ উত্থান— পৃথিবীর পক্ষে মঙ্গলজনক।
লেখকদের বক্তব্য, এর জন্য যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়েছে চিন। তার জন্য বহু দিন ধরে আমেরিকায় জাল বিস্তার করেছে চিনা লালপার্টির আন্তর্জাতিক সংযোগ বিভাগ। ওবামা প্রশাসনের মধ্যে নাকি চিনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গোড়া থেকেই সন্দিগ্ধ ছিলেন একমাত্র হিলারি ক্লিন্টন। ক্লিন্টনের চাপ ছিল বলেই ওবামা সদ্য-নিযুক্ত চিনের পার্টি প্রধান ও প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে, খোলা সমুদ্রপথে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করে সেখানে সামরিক আস্তানা বানানো থেকে চিন বিরত থাকবে। কিন্তু ওবামা তাঁর দ্বিতীয় পর্বে ক্লিন্টনকে বিদায় দিয়ে নিয়ে এলেন জন কেরিকে। কেরি, এবং ওবামার ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, এই জুটির সমর্থন ও প্রচ্ছন্ন প্রয়াসেই নাকি এই শতকের দ্বিতীয় দশকে ওয়াশিংটনের ‘বেল্টওয়ে’-তে (শহরঘেরা হাইওয়ে, বাক্যটির নিহিতার্থ হল যারা বাস করে ক্ষমতার অলিন্দে, যেমন আমাদের লাটিয়েন্স দিল্লি) চিনা লবি শিকড় বিস্তার করে। সেই সময়ে ও-দেশে আর দুনিয়া জুড়ে পরিকাঠামো নির্মাণে চিন সরকার যে বিপুল লগ্নি করছিল, তার একটি ক্ষুদ্র অংশ অন্তত পৌঁছে যায় বেল্টওয়ের সন্তানদলের পকেটে। এই সব তথ্য এই সময়ে অভ্রান্ত ডাইনামাইট, যে হেতু আগামী নভেম্বর মাসের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হচ্ছেন খোদ বাইডেন।
তবে কি এই বই ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারমাত্র? তা বোধ হয় নয়। কারণ ট্রাম্প পরিবারের সঙ্গে চিনের নানা ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথা বর্ণিত হয়েছে বইটিতে। সেই অভ্যন্তরীণ চাপের জন্য ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেই জল ঢেলে দিলেন বারোটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের বাণিজ্য জোটে, যার নাম ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ। ওই জোটটির কেন্দ্রে আমেরিকা থাকলে চিনের বাণিজ্যে বাড়বাড়ন্ত আটকে যেত মাঝপথে। অর্থাৎ শি-এর পৃথিবী জয়ের আশা, তাঁর ভাষায় ‘স্বপ্ন’, নটে গাছের মতো মুড়িয়ে যেত শুরুতেই। ট্রাম্পের কাছের লোকজনের অনেকেই ছিলেন শি চিনফিং-গোষ্ঠীর প্রভাব-বলয়ের অন্তর্গত। বাণিজ্য সেক্রেটারি উইলবার রসের একাধিক ব্যবসা চিনে মূলধন নিয়োগ করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। চিনের ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়োজিত হয় আমেরিকান কারখানাজাত নির্মাণে। এই হচ্ছে লগ্নির মাধ্যমে আমেরিকার উচ্চপ্রযুক্তির খুঁটিনাটির উপর চোখ রাখার চিনা কায়দা। সুতরাং, শিকড় ছড়িয়েছে অনেক গভীরে। অনেক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy