Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ-২

কান পেতে রাখলে অনেক কিছু জানা যায়

যখন বুনিয়াদি স্তরের শিক্ষাকর্মী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের কথা বলেন আর অমর্ত্য সেন, সুকান্ত চৌধুরীর মতো মানুষ, এমনকী শিক্ষক-সংগঠনের নেতারা মন দিয়ে শোনেন, তখন গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে ‘সবাক’ হয়ে ওঠে।বিশ্বের বৃহত্তম এই গণতন্ত্রে জন-প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হয়ে নীতি-নির্ধারকের আসনে বসেন, বরাবরই তাঁদের একতরফা বলার অভ্যেসটা বেশি। মানুষের কাছাকাছি গিয়ে মন দিয়ে তাঁদের কথা শোনার অভ্যেস প্রায় নেই বললেই চলে।

কলকাতার কাছেই। প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা চলছে। ছবি: সুব্রত জানা

কলকাতার কাছেই। প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা চলছে। ছবি: সুব্রত জানা

সীমান্ত গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

বিশ্বের বৃহত্তম এই গণতন্ত্রে জন-প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হয়ে নীতি-নির্ধারকের আসনে বসেন, বরাবরই তাঁদের একতরফা বলার অভ্যেসটা বেশি। মানুষের কাছাকাছি গিয়ে মন দিয়ে তাঁদের কথা শোনার অভ্যেস প্রায় নেই বললেই চলে। তাই কোনও আলোচনাসভায় যদি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় দেড়শো প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, চিকিৎসক, সর্বশিক্ষা অভিযানের প্রকল্প রূপায়ণের কাজে নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার, মায় সরকারি স্কুল পরিদর্শক আসেন এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরার সুযোগ পান, তখন এই শোনা এবং শোনানোর বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। আলাপ-আলোচনাগুলো তখন আর একটি মঞ্চে বা মাইক্রোফোনে সীমাবদ্ধ থাকে না, কর্মশালা শেষ হবার পরেও তা সচল থাকে ছোট ছোট বৃত্তাকার আড্ডায়। তর্ক তখন তর্কের খাতিরে চালিত হয় না। পারস্পরিক মত বিনিময়ের মাধ্যমে অনেক বিতর্ক তখন গন্তব্য খুঁজে নিতে সচেষ্ট হয়।

সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাস্টের ‘শিশু স্বাস্থ্য: নানা দিক, নানা মত, নানা কাজ’ বিষয়ক বার্ষিক কর্মশালায় মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আগত এক জন প্রাথমিক স্কুল-শিক্ষক যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য বলছিলেন, যে মানুষটি দর্শকাসনের পিছনের সারিতে বসে মন দিয়ে শুনছিলেন, তাঁর নাম অমর্ত্য সেন। সেই মাস্টারমশাই বলছিলেন, শিশুদের দুপুরে টিফিনের সময় মিড-ডে মিল দেবার বদলে যদি সকালে স্কুল শুরুর আগে খাবারটা দেওয়া হয়, তা হলে ওদের পড়াশুনোয় একটু সুবিধা হয়। কেননা অধিকাংশ শিশুই সকালে না খেয়ে আসে, স্কুলের প্রথম পর্বের ক্লাস খালিপেটে হজম করতে ওদের অসুবিধা হয়। অধ্যাপক সেন পরে কথা প্রসঙ্গে শুধু এইটুকুই জানালেন, ‘দাবিটা ভেবে দেখবার মতো’।

দৃষ্টান্তমূলক ব্যক্তিগত উদ্যোগ কি আদৌ সরকারি স্তরে কোনও প্রেরণা সঞ্চার করতে পারে, না কি তা সরকারকে আরও অকর্মণ্যতার দিকে ঠেলে দেয়— এই বিতর্কেও অনেকদূর অগ্রসর হওয়া গেল। এক জন প্রাথমিক স্কুল-শিক্ষক বাচ্চাদের ‘রানিং ওয়াটার’-এ হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে মরিয়া ছিলেন। তিনি জানতেন, গামলায় জল রেখে তাতে যদি একাধিক শিশু হাত ধোয়, তা হলে রোগ-সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। স্কুলে জলের কল নেই। তিনি তখন একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন। প্লাস্টিকে তৈরি নরম-পানীয়ের বোতলের নীচে চার দিকে চারটি ছিদ্র করে, সেই বোতলে জল ভরে সেটি ঝুলিয়ে দিলেন। ব্যস, রানিং ওয়াটারে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। মুশকিল হল, বিদ্যালয়ে জল সরবরাহের দায়িত্ব রয়েছেন যে সব সরকারি আধিকারিক, তাঁরা এই উদ্ভাবনের খবরটি পেলে তো সেই স্কুলে আর জলের ব্যবস্থা করতে আগ্রহী হবেন না। অথবা, এর পর থেকে চাপাকল বসাবার বদলে স্কুলে স্কুলে নরম পানীয়ের খালি বোতল পাঠিয়ে দেবেন। তা হলে কী করণীয়? প্রশ্নটা থেকে গেল।

প্রসূতি মায়ের পুষ্টিরক্ষা ও নিয়মিত দেখভাল, হাসপাতালে প্রসব, সদ্যোজাত শিশুকে মাতৃদুদ্ধ পান করানোয় উৎসাহ প্রদান, টিকে দেওয়া, শিশুর রক্তাল্পতারোধে আয়রন বড়ি বিলি ইত্যাদি কর্মসূচিগুলোতে গত পাঁচ বছরে ভারতে ভাল কাজ হয়েছে। বাংলাদেশ বা নেপালের তুলনায় আমরা এখনও অনেকটা পিছিয়ে, কিন্তু অগ্রগতি খুব খারাপ নয়। তবু পুরুলিয়ার জনজাতি এলাকায় কর্মরত এক জন ‘আশাদিদি’ যখন জানান যে, সুতির কাপড়ের অভাবে সদ্যোজাত শিশুকে মুড়ে রাখার কাজে তাঁদের খুবই অসুবিধা হয়, তখন ভাবি, ঠিকই তো, গ্রামের গরিব দিনমজুরের পরিবারে আজকাল সুতিবস্ত্র সত্যিই দুর্লভ, সস্তা সিন্থেটিক বা পলিয়েস্টার শাড়িই সেখানে চলে। কান না পাতলে এই অতীব জরুরি প্রয়োজনের কথাটি তো জানাই হত না।

যাঁরা কাজ করেন তাঁদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলে বহু অজ্ঞতা-প্রসূত বিভ্রমও দূর হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের ধর্মীয় পরিচিতিটাই যেমন আমাদের কাছে পশ্চাৎপদতার অভিলেখ। পর্দাপ্রথা, জন্ম-নিয়ন্ত্রণে অনীহা, শিক্ষা-বিষয়ে গোঁড়ামি ইত্যাদির কথাই তো আমরা বরাবর শুনে এসেছি। কিন্তু যদি কেউ মুর্শিদাবাদের চর-লবণগোলা থেকে আসা অঙ্গনওয়াড়ি নাসিমার কথা শোনেন, প্রত্যক্ষ করেন নারী ও শিশুবিকাশের কাজে তাঁর আত্মবিশ্বাসী মূর্তি, তাঁর ধারণাগুলো বদলে যেতে বাধ্য। আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, এ-রাজ্যে মুসলিম মেয়েরা বিপুল সংখ্যায় স্কুলে যাচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় এই অগ্রগতি, তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন নাসিমারাই।

ধ্বনিত হয় নিরাশার কিছু শব্দও। দার্জিলিং জেলা থেকে আগত প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্কুলে এসে অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুকে কাঁধে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দৌড়েছিলেন। সেখানে নোংরা বিছানায় শিশুটিকে শোয়াতে রাজি না হওয়ায় চরম দুর্ব্যবহার পেয়েছিলেন নার্সদের কাছ থেকে। অন্য এক প্রধান শিক্ষিকা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, পঞ্চায়েত অফিসের বাইরে পড়ে থাকা কিছু পুরনো বাতিল লোহার পাইপ স্কুলের কাজে ব্যবহারের জন্য চেয়ে পাননি। সরকারি জিনিস নাকি ও ভাবে ‘যাকে তাকে’ দেওয়া যায় না। বীরভূম জেলারই এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মাত্র তিন শতক পরিমাণ জমি নিয়ে স্থানীয় হাইস্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর বিবাদের কথা জানালেন। ‘নিজেদের সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ওই জমিটুকু ওঁরা আইনের নানা অজুহাতে আটকে রেখেছেন আর আমাকে ক্লাস করাতে হচ্ছে রাস্তার ধারে বেড়ার ঘরে। অথচ ওঁরা এইটুকু ভেবে দেখছেন না যে, আমার সেন্টারের বাচ্চারা বড় হয়ে ওই স্কুলেই পড়তে যাবে।’

সর্বশিক্ষা অভিযানের কলকাতা কেন্দ্রের কর্মী উর্বা চৌধুরি যখন জানান, কলকাতা জেলায় স্কুলছুটের সংখ্যা উদ্বেগজনক, তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। কলকাতার তুলনায় তাঁর জেলায় দারিদ্র তো বহুগুণ বেশি, তা হলে? উর্বাদেবী বলেন, ‘সারা পশ্চিমবঙ্গ, এমনকী ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও বহু শ্রমজীবী পরিবার কাজের সন্ধানে ছ’মাস বা আটমাসের জন্য কলকাতায় চলে আসে। শিশুরাও আসে তাদের সঙ্গে। তখন তারা আমার জেলার শিশু হয়ে যায় এবং তাদের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবার দায় আমার ওপরও বর্তায়।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘...আপামর সাধারণকে আমাদের সঙ্গে অন্তরে অন্তরে এক করিতে না পারিলে যে আমরা কেহই নহি, একথা কিছুতেই আমাদের মনে হয় না। সাধারণের সঙ্গে আমরা একটা দুর্ভেদ্য পার্থক্য তৈরি করিয়া তুলিতেছি। বরাবর তাহাদিগকে আমাদের সমস্ত আলাপ-আলোচনার বাহিরে খাড়া করিয়া রাখিয়াছি।’ তবু রবীন্দ্রনাথের সেই বোলপুরের ভূমিতেই যখন এই ভাবে একেবারে বুনিয়াদি স্তরের শিক্ষাকর্মী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের কথা বলেন আর অমর্ত্য সেনের পাশাপাশি অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর মতো বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত, লিভার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ চৌধুরির মতো সদাব্যস্ত চিকিৎসক, শিশু-সুরক্ষা আয়োগের চেয়ারম্যান অশোকেন্দু সেনগুপ্তের মতো মানুষ, এমনকী রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা শিক্ষক-সংগঠনের একাধিক নেতা ঠায় বসে মনোযোগী ছাত্রের মতো তাঁদের কথা শোনেন, তখন গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে ‘সবাক’ হয়ে ওঠে। আশা জাগে।

অন্য বিষয়গুলি:

child education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy