গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭— ব্রিটিশ ভারতে প্রশাসনের রাশ ছিল আইসিএস-দের হাতে। কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে প্রতি বছর চাকরিতে ঢুকতেন দশ-বিশ জন। অথচ যে দেশটা চালাতেন তাঁরা, তা আজকের ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ, মায়ানমারের সমান। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট থেকে চিফ সেক্রেটারি, এমনকি, গভর্নর পর্যন্ত সব পোস্টই ছিল আইসিএসের হাতে। ক্ষমতায়, সুযোগসুবিধায় এঁরা ছিলেন অনন্য। এঁদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। তবে ১৯৩৫-এর পরে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে অনেকেই মানিয়ে চলতে পারেননি।
তাই স্বাধীনতার পরে যখন প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা শুরু হল এবং প্রশ্ন উঠল আইসিএসের ধাঁচে একটা সার্ভিস তৈরি করা হবে কি না, তখন অনেকেই প্রস্তাবের পক্ষে বললেন। আবার অনেকে বিপক্ষে।
জওহরলাল নেহরু ছিলেন আইসিএসের ঘোর বিরোধী। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘‘আইসিএস ইন্ডিয়ানও নয়, সিভিলও নয়, সার্ভিসও নয়।’’ যাকে জোরালো সমর্থন জানালেন সর্দার বল্লভ ভাই পটেল। কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বিতর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘‘দেশকে বাঁচাতে হলে সর্বভারতীয় সার্ভিস তৈরি করে অফিসারদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে হবে। যাতে তাঁরা নির্ভীক ও নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে পারেন।’’ সে কথা মাথায় রেখেই তৈরি হল ১৯৫৩ সালের সিভিল সার্ভিস আইন এবং তার নিয়মাবলি।
আইসিএস অফিসারের সংখ্যা ছিল নগণ্য। কারণ, তাঁদের কাজও ছিল কম। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা আর রাজস্ব আদায়। স্বাধীন দেশে সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হবে দারিদ্র দূরীকরণ এবং দেশ জুড়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোয় উন্নয়ন। তার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় অফিসার নিয়োগ করতে হবে। অফিসারের যোগ্যতা ঠিক করতে হবে। তাই অনেক অধিনিয়ম তৈরি হল। এর একটা হল ১৯৫৪ সালের আইএএস ক্যাডার রুল। প্রত্যেক রাজ্যের জন্য বা কয়েকটা ছোট রাজ্যের জন্য একটা করে ক্যাডার তৈরি হল। বলা হল, কেন্দ্র-রাজ্য পরামর্শ করে ঠিক করবে কোন ক্যাডারে কত অফিসার দরকার। সেই অনুযায়ী ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রতি বছর অফিসার নিয়োগ করা হবে। অফিসারের দক্ষতা সুনিশ্চিত হল।
কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু আলাদা ক্যাডার বলে বিবেচিত হল না। কেন্দ্র সরাসরি কোনও আইএএস অফিসারকে নিয়োগ করবে না। কেন্দ্রে অফিসার আসবে রাজ্য থেকে। রাজ্য সরকার অফিসারদের কাছে জেনে নেবে সে বছর কে কে কেন্দ্রে যেতে চান। ইচ্ছুক অফিসারদের তালিকা পাঠানো হবে কেন্দ্রে। সব রাজ্যের তালিকা দেখে কেন্দ্র বিভিন্ন পোস্টের জন্য অফিসার বেছে নেবে। নির্বাচিত অফিসার কেন্দ্রে কাজ করবেন পাঁচ বছর। তার পর ফিরে আসবেন নিজের ক্যাডারে। একটা নির্ধারিত সময় ক্যাডারে কাটিয়ে তিনি আবার ফিরতে পারবেন কেন্দ্রে।
আপাতদৃষ্টিতে জটিল মনে হলেও এই পদ্ধতিতে কাজ চলে আসছে ৭৫ বছর। জেলায়, মাঠেঘাটে কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে কেন্দ্রের নীতি নির্ধারণে। দিল্লিতে অন্য রাজ্যের অফিসারদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে রাজ্যে ফিরে প্রশাসনকে চাঙ্গা করতে। আরও লাভ— অফিসারদের একটা সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে। এই কারণেই আইএএস বেশ খানিকটা সফল হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্যে সমন্বয় সাধনে আর যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে বলিষ্ঠ করতে।
অন্য দিকে, মাঝেমধ্যে কিছু সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে। কখনও যথেষ্ট সংখ্যায় অফিসার পাওয়া যায় না, যাঁরা দিল্লিতে আসতে চান। কখনও রাজ্য সরকার ইচ্ছুক অফিসারদের ছাড়তে চায় না। কারণ, তাদের নিজেদের অভাব। কিন্তু এই সমস্যা কেন্দ্র ও রাজ্য বসে কেন মিটিয়ে নিতে পারে না? বছরে এক বার বসলেই বোঝা যায়, আগামী তিন বছরে ক’টা বাড়তি পোস্ট দরকার। কত অফিসার অবসর নেবেন। দু’টি সংখ্যা যোগ করলেই হয়! ১৯৯০-এর দশকে উদারীকরণের সময় ভাবা হয়েছিল, সরকারের কাজকর্ম কমে যাবে। তাই বাৎসরিক নিয়োগ ১৬০ থেকে কমিয়ে ৬০ করে দেওয়া হয়। সেই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে এখনও।
কেন্দ্রীয় সরকার এখন ক্যাডার রুলে যে সংশোধনী আনতে চাইছে তার দু’টি ভাগ।
প্রথমে বলা হচ্ছে, কয়েকটি স্তরে অফিসারের অভাব। তাই কেন্দ্র অফিসার চাইলে রাজ্য তাতে ‘না’ বলতে পারবে না। আগেই বলা হয়েছে, অভাব অফিসারের নয়, অভাব সুবুদ্ধির। অভাব কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতার। সংশোধনী না এনে তাই উচিত হবে একটু গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করা। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের অধীনে সেন্ট্রাল সার্ভিস থেকে জয়েন্ট সেক্রেটারি স্তরে নিয়োগ বেড়েছে।
এ ছাড়াও বলা হচ্ছে, অফিসারের ঘাটতি মেটাতে প্রাইভেট সেক্টর থেকে ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের আনা হবে। রাজ্য থেকে কেন্দ্রে এসে সময়মতো প্রোমোশন পাওয়ার পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। তা হলে কেনই বা রাজ্যের অফিসার যেতে চাইবেন কেন্দ্রে!
প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে বলেন, ‘আইএএস বাবু’দের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে আমরা ভুল করেছি, তখন বিভ্রান্তি আরও বাড়ে। তবে এ কথা ঠিক নয় যে, সব দোষ কেন্দ্রের। বেশির ভাগ রাজ্যই কেন্দ্রে নাম পাঠানোর ব্যাপারে উদাসীন। কেউ কোনও নীতি তৈরি করেছে বলে আমি অন্তত শুনিনি। পাঁচ জন দিল্লি যেতে চাইলেন। দু’জনের নাম পাঠানো হল। ভাল অফিসার, তাই ছাড়া যাবে না। এই যদি নীতি হয়, তা হলে তা ব্যুমেরাং হতেই পারে! এক পুলিশ অফিসারকে সিবিআই-এর জন্য ছাড়তে রাজি হয়েও এক রাজ্য সরকার পরে তাঁকে ছাড়েনি। তিনি আদেশ অমান্য করে দিল্লি গেলে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। এ ধরনের ঘটনার প্রভাব অনেক দূর গড়ায়।
সংশোধনীর দ্বিতীয় ভাগ সত্যিই বিপজ্জনক। কেন্দ্র চাইলে যে কোনও অফিসারকে চেয়ে পাঠাতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বা সেই অফিসার— কারও কিছু বলার থাকবে না। এবং তাঁকে ডেকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যে তাঁকে কেন্দ্রেই নিয়োগ করবে তা নয়। দেশের যে কোনও জায়গায় পাঠাতে পারবে। অবশ্যই কোনও পোস্টিং না করে ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এও রেখে দিতে পারবে।
অতি সম্প্রতি আমরা দেখেছি, এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী ভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা হয়েছে। তাই যদি হয় তা হলে কি নির্ভীক ও নিরপেক্ষ অফিসার পাওয়া যাবে? আইএএসের জনক সর্দার পটেলের স্বপ্ন সার্থক হবে? মনে হয় ফল হবে ঠিক উল্টো। অফিসাররা ভুগবে নিরাপত্তার অভাবে। রাজ্য সরকারের কাজ বিঘ্নিত হবে। আমাদের সময়ে আইএএসের বিকল্প ছিল না। আজকে পরিস্থিতি ভিন্ন। ভাল ছেলেমেয়েরা আসবেনই না এই সার্ভিসে।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy