শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক। — ফাইল চিত্র।
নূতন শিক্ষানীতি ঘোষণা করিয়া সরকার জানাইয়াছিল, তাহার প্রয়োগে বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়া নাই। তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনও অজ্ঞাত কারণে মত পাল্টাইলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক। যথাসম্ভব দ্রুত এই নীতি কার্যকর করিবার জন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি আহ্বান করিয়াছেন তিনি। এহেন তাড়া বিস্ময়কর, বিপজ্জনকও বটে! বর্তমানে করোনাভাইরাস-জনিত অতিমারির দাপটে দেশে রীতিমতো জরুরি অবস্থা জারি, যাহার অন্যতম প্রধান শিকার শিক্ষাব্যবস্থা। প্রতিটি স্তরে লেখাপড়া স্তব্ধ। আগামী এক বৎসরে তাহার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াইবে, কাহারও নিকট স্পষ্ট নহে। ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সরকার সকলেই দিশাহারা। বাদানুবাদ চলিতেছে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের ভিতর, যাহা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াইতেছে। সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার তারিখ পর্যন্ত এখন তীব্র সংঘাতের বিষয়। সর্বস্তরে লেখাপড়াই যেখানে এই ভাবে থমকাইয়া, তেমন সময়ে গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বুনিয়াদি নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত? এই মুহূর্তে নিকট ভবিষ্যৎই অনিশ্চয়তার অতল জলে, তাহার মধ্যে দাঁড়াইয়া দূর ভবিষ্যতের শিক্ষা-কাঠামো তৈরি? কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্যাখ্যা করিয়াছেন, দেশের স্বার্থে সংস্কার চালু করিবার বিষয়ে আর বিলম্ব চলিবে না। প্রশ্ন উঠিবে, কিসের স্বার্থ? কাহাদের স্বার্থরক্ষার কথা ভাবিতেছে সরকার? বিপদগ্রস্ত সময়ে বিপদের মীমাংসা না করিয়া তাড়াহুড়া করিয়া নূতন নীতির প্রয়োগই দেশের স্বার্থরক্ষার প্রকৃষ্ট উপায়— এমন ছেলেভুলানো বাক্য কাহাকে শুনাইতেছেন মন্ত্রিবর? দেশের নাগরিককে কি তাঁহারা অবোধ শিশু ভাবেন?
বিষয়টি বিপজ্জনক এই জন্য যে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি লইয়া নানাবিধ আশঙ্কা ও আপত্তি উপস্থিত হইয়াছে, যাহা সমগ্রত ‘রাজনৈতিক বিতণ্ডা’ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। নূতন শিক্ষানীতি ও তাহার প্রয়োগ লইয়া বিভিন্ন রাজ্য হইতে প্রতিবাদ ও সংশোধনের দাবি ধ্বনিত হইতেছে। পশ্চিমবঙ্গ তাহার অন্যতম। প্রসঙ্গত, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সহিত আলোচনা করিয়া নীতি প্রস্তুত হইলেও সেই কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের কেহ ছিলেন না। ইহার পরে রাজ্য লিখিত বক্তব্য প্রেরণ করিলেও তাহা অগ্রাহ্য করা হইয়াছে। ভারতীয় সংবিধানমতে, শিক্ষা কিন্তু যৌথ তালিকার অন্তর্গত, এখনও। তবে কী রূপে একটি রাজ্যের বিশেষজ্ঞদের মতামত বিনা সেই রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা তৈয়ারি হয়? কেন রাজ্যের মতামত গ্রহণ না করিয়া কেন্দ্র একক সিদ্ধান্ত লয়? কেন্দ্রীয় নীতি ঘোষিত হইবার পর একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করিয়াছিল রাজ্য। আপত্তির স্থানগুলি চিহ্নিত করিয়া কেন্দ্রের নিকট রিপোর্ট পাঠাইয়াছিল। কিন্তু আপত্তি না শুনিয়াই যদি নীতি প্রযুক্ত হয়, তবে সকল পদ্ধতি, সকল কমিটিই অর্থহীন।
নীতি ঘোষণার সময়েও তাড়াহুড়া বড় কম ছিল না— সংসদকে এড়াইয়াই এত বড় সংস্কার প্রণীত হইয়া গেল। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাড়াহুড়ার পিছনে প্রণোদনাটি ঠিক কিসের? শাসক দলের কিছু হিসাব মিলাইবার প্রয়োজন? কী সেই হিসাব? এই মুহূর্তে তাহাদের সম্পাদ্য কার্যাবলির অন্যতম হিন্দি ভাষার প্রচার-প্রসার। নূতন নীতির রূপরেখা দেখিয়া বহু রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, সরাসরি না হইলেও পিছনের দরজা দিয়া সমগ্র দেশে হিন্দি চাপাইয়া দিবার প্রয়াস আছে বাধ্যতামূলক ত্রি-ভাষা নীতির মধ্যে। ‘এক দেশ এক নীতি’ নামক রাজনৈতিক ধুয়াটি শুনিতে নেহাত নিরীহ হইতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহার মধ্যে দেশের বহু-সংস্কৃতির বিষয়টি লঙ্ঘিত হইবার বিপুল আশঙ্কা জ্বলজ্বল করিতেছে। বহুভাষিক, বহু-ধর্মী, বহু-সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে যে শাসক দল সম্মান করিতে জানে না, তাহার এই অতি-ত্বরান্বিত সংস্কার দেশের অনপনেয় ক্ষতি করিয়া দিতে পারে, সন্দেহ কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy