ব্রেক্সিট সম্পর্কে ভাবতে গেলে ফ্রেডরিক ফন হায়েক-এর একটা উক্তি মনে পড়ে। ইতিহাস হল মানুষের পুরনো কর্মের তামামি, মানুষের বর্তমান পরিকল্পনার দাস নয়। বিশ্বায়নের তো পিছন দিকে হাঁটার কথা ছিল না। ২০০৭ সালের লিসবন চুক্তিতে ৫০ নম্বর ধারাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সংযুক্ত ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাব্য পথ হিসেবে, কিন্তু এই ধারা প্রয়োগ করার কোনও চিন্তাই তখন ছিল না। ব্রিটিশ রাজনীতিকরা ধারাটি রাখতে চেয়েছিলেন দেশে এই চুক্তির সমর্থন বাড়াতে। তাঁদের ধারণা ছিল: ব্রিটিশ জনতা ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ এমন ভাবনাতেই এই চুক্তি প্রয়োগ পর্যন্ত কখনওই পৌঁছবে না।
কিন্তু ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে টাওয়ার ব্রিজের নীচ দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে, তিনটি বিষয়ে অনেক ওলটপালট হয়েছে। প্রথম, ইমিগ্রেশন বা অভিবাসন। ব্লেয়ার ও বুশের যৌথ বিদেশনীতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ধারণাকে আরও বেশি চাঙ্গা করল, পূর্ব ও দক্ষিণের আরও দশটি দেশ অন্তর্ভুক্ত হল ২০০৪ সালে। ব্রিটিশ জনতা সহসা আবিষ্কার করল, যেখানে স্বাভাবিক ভাবে কয়েক হাজার লোক আসার কথা, মুক্ত অভিবাসন নীতির সুযোগে সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক চলে এসেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে।
দ্বিতীয় বিষয়টি আরও গুরুতর: ২০০৮ সালের তীব্র আর্থিক মন্দা। ভারতে তার খুব বেশি প্রভাব না পড়লেও ব্রিটেন কিন্তু নড়ে গিয়েছিল। মন্দা যে হেতু এসেছিল ব্যাঙ্কিং সঙ্কটের হাত ধরে, তাই সরকার উদার হস্তে এগিয়ে এল ব্যাঙ্ককে আর্থিক সাহায্য করতে। অন্য দিকে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য বাজেট কমতে শুরু করল আর্থিক সঙ্কটের দোহাই দিয়ে। বহু সংস্থা দেউলিয়া হল এক দিকে, অন্য দিকে সরকারি টাকায় ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত একটি শ্রেণির শ্রীবৃদ্ধি ঘটল। এই অসাম্য এক তীব্র চাপা অসন্তোষের বীজ বুনে দিল।
তৃতীয় বিষয়টি সরলতর: রাজনীতিক শ্রেণির ওপর বাড়তে থাকা অবিশ্বাস। প্রবল আর্থিক সঙ্কট, এ দিকে এমপিদের একের পর এক আর্থিক অনিয়ম আর কেলেঙ্কারি। জনমনে তৈরি হল অদ্ভুত বিরাগ।
১৯৯০-এর দশক থেকেই, পাশ্চাত্যের অনেক দেশের মতোই ব্রিটেনও একটা ভোগবাদী গণতন্ত্রের জয়যাত্রায় শামিল হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কিছু সময় রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছিল দেশ গড়ার অর্থনীতির চেতনা থেকে, কিন্তু ক্রমশ সেখানে জায়গা করে নিল মার্গারেট থ্যাচার প্রভাবিত চিন্তা। রাজনীতির মূল সুর হয়ে দাঁড়াল ভোগবাদ ও আর্থিক প্রতিপত্তির তোষণ। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা তার মূলে আঘাত হানল। ইউরোপের মানুষের জন্য মুক্ত অভিবাসন, মন্দা কাটাতে সরকারি উদ্যোগে অসাম্য আর রাজনীতিকদের প্রতি বাড়তে থাকা বিরাগ— এই ত্র্যহস্পর্শে মানুষের বিরক্তি ও ক্রোধ একটা ছাইচাপা আগুনের চেহারা নিয়ে ফেলল।
সিরিয়া থেকে আগত অভিবাসীদের অচেনা মুখ, ইউরোপের অন্য দেশের আমলাদের খবরদারি, ব্রিটেনের স্বাস্থ্য পরিষেবায় আর্থিক সংস্থানের মায়াজাল— এই সব কিছু দিয়েই সোশ্যাল মিডিয়া গ্রাস করে ফেলল চেতনা। সত্য ও অপসত্যের ভেদ মিলিয়ে গেলে সব কিছুই সম্ভব বলে মনে হল। যুক্তি হারাল তার গতিপথ। ব্রেক্সিট যেন নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার মাদকতা— সাধারণ মানুষ একটা ঘোরের মধ্যে প্রভাবশালী শ্রেণির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার আত্মপ্রসাদ খুঁজল। ২০১৫ সালের ২৪ জুন গণভোটের ব্রেক্সিটে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ইউরোপ আর সমুদ্রের মধ্যে যদি বেছে নিতে হয়, তা হলে ব্রিটেনের উচিত খোলা সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া। চার দিকে সাগর-ঘেরা দ্বীপসাম্রাজ্য আর বহির্বাণিজ্যভিত্তিক উপনিবেশ ব্রিটেনের সঙ্গে মূল ইউরোপের সম্পর্কের ইতিহাসে সব সময়েই থেকেছে টানাপড়েন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেও ব্রিটেন নিজেকে ভেবেছে তিন শক্তির সংযোগসূত্র, মূল ইউরোপ, আমেরিকা ও কমনওয়েলথ। ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের রাজনীতির আবর্তে সংযুক্ত ইউরোপের সদস্য হওয়ার পরেও এর বাঁধন থেকেছে আলগা, একা থাকার প্রচ্ছন্ন বাসনা তাকে পোক্ত হতে দেয়নি।
এই ভবিতব্য হয়তো অবধারিত ছিল। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, অধুনা হার্ভার্ডের অর্থনতিবিদ রডরিক বলেছিলেন, একটি দেশে বিশ্ববাণিজ্য, গণতন্ত্র ও জাতীয় রাষ্ট্র (nation-state), এই তিনটের সহাবস্থান বোধ হয় সোনার পাথরবাটির মতো— যে কোনও দুটোকে বেছে নিতে হবে। ডেভিড ক্যামেরনের একটা রাজনৈতিক ফাটকা কাকতালীয় ভাবেই বোতল থেকে দৈত্যকে বার করে ফেলেছে, গণতন্ত্রের সঙ্গে গণভোটকে গুলিয়ে ফেলার নিদারুণ পরিণাম ডেকে এনেছে।
তবে, ব্রিটেন আজ বেরিয়ে যেতে চাইলেও বৃহত্তর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে ব্যাপারটা তত সহজ নয়। আয়ারল্যান্ডের স্বার্থ নিয়েই আছে বড় প্রহেলিকা। তাই ব্রেক্সিট নিয়ে শুরুতে পেশি-আস্ফালনের মোহ কেটে যাওয়ার পর এখন অনন্ত জটিলতা, যার সুরাহার পথ এখনও স্পষ্ট নয়।
ইতিমধ্যে এক বিদীর্ণ ব্রিটিশ সমাজের ভাবনায় শত ব্রেক্সিট বিকশিত হতে শুরু করেছে। লেবার পার্টির নেতা ও ব্রেক্সিটের প্রচ্ছন্ন সমার্থক জেরেমি করবিন ভাবছেন, ব্রিটেন আবার থ্যাচার-পূর্ব যুগে ফিরে যাবে, আর রাষ্ট্রায়ত্ত সমাজতান্ত্রিক বিকাশের পথ ধরবে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভাবছেন, ব্রিটেন ইউরোপের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এক নতুন সিঙ্গাপুর হবে, যেখানে ট্যাক্স কম আর বাণিজ্য বিশ্বায়িত, যা ভোগবাদের ‘সব পেয়েছির দেশ’। জার্মান ও ফরাসি সঙ্গিনী নিয়ে দক্ষিণপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজ ভাবছেন, ব্রিটেন অভিবাসীমুক্ত সাদা চামড়ার দেশ হয়ে উঠবে। ব্রেক্সিটপন্থী ভারতীয়রা ভাবছে, পূর্ব ইউরোপের মানুষ কমে গিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতীয় সেখানে ঘাঁটি গাড়বে। ব্রেক্সিটের এই নানা স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ আর বিশ্বাসহননের মাঝে দিশাহারা ব্রিটেনবাসী তাকিয়ে আছে তার বিচারব্যবস্থা ও বাকিংহাম প্যালেসের দিকে।
টেনিদার ভাষায় অবস্থা পুঁদিচ্চেরি। ব্রিটেন অবাক হয়ে দেখে, এক মার্কিন কূটনীতিক উল্টো দিক থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে ১৯ বছরের যুবককে চাপা দিয়ে ফেলল। ব্রিটেনের এই মুহূর্তের দিশাহীনতার মূর্ত প্রতীক যেন এই ঘটনা, কোন দিক থেকে কে আসছে, কোথায় যাচ্ছে, সব তালগোল পাকানোর জোগাড়।
তবে একটা ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এক সময় যে সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেই রাষ্ট্রের এক নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে। অতীতের অনেক প্রজন্মের কর্মের ভার ঘাড়ে নিয়ে পরের প্রজন্ম ইতিহাস লেখে। ব্রেক্সিট কি তবে তাই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy