২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হাওড়ার ধুলাগড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে উত্তরপ্রদেশে দলের বিপুল জয়ের পর বিজেপির এক শীর্ষ নেতা তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সে দিন খুশিতে চনমনে নেতাটি আমাকে বলেছিলেন, ‘ধুলাগড়ে এত কিছু হল, আপনার কাগজ সে ভাবে পাবলিসিটিই দিল না। উত্তরপ্রদেশের খবরের কাগজগুলোর এই ব্যাপারে আপনাদের মতো রক্ষণশীলতা নেই।’ এর পর নেতাটি বলেছিলেন, ‘আমরা বুঝে গেছি, ধুলাগড়ের মতো ঘটনা আবার হলে তার প্রচারেও লাগাম টানবেন। তাই এ বার আমাদের কৌশল, আপনাদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অগ্রাধিকার দেব। এখনই আমরা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করব সোশ্যাল মিডিয়ায়।’
এ বার বসিরহাটের ঘটনার পর সেই ঠোঁটকাটা বিজেপির নেতাটির কথা মনে পড়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গ যে বিজেপি নেতৃত্বের অগ্রাধিকার, সে তো আজ আমরা সবাই জেনে গেছি। অসমে বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পর বিজেপি নেতাদের ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে, যে সব রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যার প্রাধান্য সেখানেই বিজেপির নির্বাচনী সাফল্য আসা সহজ। অসমে আমরা সফল হয়েছি এ বার বাংলাতেও হব।
অতএব পশ্চিমবঙ্গ এখন বিজেপির ল্যাবরেটরি। দার্জিলিঙে আবার গোর্খাল্যান্ডের দাবি উঠছে। বিজেপি বলছে, পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বসিরহাটে ফেসবুকের একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে যে অপ্রীতিকর ঘটনাবলি ঘটল, তা দেখেই বিজেপির দাবি, রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করতেই হবে। দিল্লির হিন্দি ইংরেজি চ্যানেলগুলিতেও কয়েক দিন ধরে চলল এক ভয়াবহ প্রচার। প্রচারের দুরাচার যা-ই হোক, বাস্তবে কিন্তু দেখা গেল, এলাকার মানুষ, কী হিন্দু কী মুসলিম, দু’পক্ষই একই ভাবে শোকাহত। হিংসায় যে কোনও পক্ষেরই লাভ হয় না, সে শিক্ষা আমরা ইতিহাস থেকে বার বার নিয়েছি। রাজনীতির মুনাফা লাভে লোলুপ রসনা অবশ্যই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি থেকেই সুবিধা নিতে চায়। ধুলাগড়ে এই সুবিধা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল বিজেপি। বসিরহাটেও তাদের উদ্দেশ্য এখনও সফল হয়নি।
সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে কেন সাফল্য অর্জন করতে পারছে না? আমার মনে হয় তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব নিহিত বাঙালির আত্মপরিচয়ের ইতিহাসেই। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা সে দিন ফোন করে বললেন, ‘আপনারা কি হিন্দু-বিরোধী হয়ে গিয়েছেন? মুসলিম মৌলবাদকে দেখেও দেখছেন না?’ বললাম ‘হিন্দু হতে গেলে কি মুসলিম-বিরোধী হতেই হবে? আর হিন্দু কে? আমি তো সেই কোন ছোটবেলা থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা ‘যত মত তত পথ’ মেনে চলা হিন্দু। হিন্দু হওয়া মানে বরং সকল ধর্মকে নিয়ে চলার সহিষ্ণুতা। একদা কিছু আচারসর্বস্ব ব্রাহ্মণ অত্যাচারী শোষক হয়ে ওঠে। তার জন্য হিন্দু ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল।’
ওই নেতাটি বললেন, ‘হিন্দুরা আক্রমণের শিকার হলে আপনারা নীরব। মুসলমানরা হলে সরব।’ আমি বললাম, ‘এই ধারণাটি সম্পূর্ণ অসত্য। আমরা দলীয় রাজনীতি করি না। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে মূলধন করে লোক খেপিয়ে টিআরপির ব্যবসা করছি না। বরং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যদি প্রবৃত্তির বিকার হয়, তবে সেখানেই বার বার খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তপাত না করে নিবৃত্তিমার্গে যাওয়ার চেষ্টাই কি উচিত কাজ নয়?’ বললাম, ‘নেতি নেতি না করে সকলকে নিয়ে চলাই হিন্দুধর্মের মূল সত্য। এই মূলেই আমরা অনুগত। বরং বলতে পারেন ‘মৌলবাদী’ হিন্দু আমরাই, বিজেপিই হিন্দুধর্মকে বিকৃত করছে। বেদে বহু বার গরু খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিজেপি তার সত্যতা স্বীকার করে না।’
বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিকাশের পটভূমি আলাদা। হিন্দি বলয়ের ইতিহাসের সূত্র ধরে বাংলায় এগোতে গিয়ে তাই মস্ত ভুল করছে বিজেপি। মনে রাখতে হবে, আর্যরা বাংলায় এসেছে অনেক পরে। চতুর্বর্ণের বিকাশও সে ভাবে ঘটেনি। বাংলায় জাতিবৈরিতা ছিল, মুসলমানরা আসার আগে বারে বারে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে অন্যদের সংঘাতও হয়েছে। কিন্তু দেশের বহু অঞ্চলে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে অস্ত্র করে বিজেপি আসনসংখ্যা বাড়িয়েছে, সেই কৌশলে বিজেপি-র ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ। আডবাণীর রথযাত্রার সময় সেটি ছিল অনেক বেশি তাত্ত্বিক বিষয়। মোদী অমিত শাহের জমানায় সেটি অনেক বেশি প্রায়োগিক।
একটা কথা বলা দরকার। এই মেরুকরণের লাভ যে বিজেপি পেয়েছে তার পিছনে মুসলিম ভোট ব্যাংকের রাজনীতি নিশ্চয়ই একটা কারণ। পশ্চিমবঙ্গে অতীতে কংগ্রেস, সিপিএম ও পরবর্তী কালে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলিম ভোট ব্যাংককে খুশি রাখতে চেয়েছে। সে কথা সত্য। কিন্তু এর আগে কখনও তার ‘কাউন্টারন্যারেটিভ’ তৈরি করে পাল্টা সাম্প্রদায়িকতার হিংসা তৈরি করার রাজনীতি বঙ্গবাসী দেখেনি। এখন দেখছে।
বাংলার মুসলমানদের তিনটি বর্গে ভাগ করা হয়। আগন্তুক মুসলমান, ধর্মান্তরিত মুসলমান ও উভয়ের মিশ্রণে তৈরি মুসলমান সমাজ। ধর্মান্তরিত মুসলমান বর্গ সংখ্যায় ছিল সব চেয়ে বেশি। ১২০৩ সালে বখতিয়ার খলজি প্রথম বাংলা জয় করেন। তার পর থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের দেওয়ানি গ্রহণ করার সময় পর্যন্ত সার্ধ পাঁচশো বছর, বাংলা মুসলমানদের অধীনে ছিল। মুর্শিদকুলি খানের আমলে কোনও হিন্দু জমিদার রাজস্ব দিতে অক্ষম হলে তাঁকে সপরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হত। উচ্চবর্ণের অত্যাচারেও বহু নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমান হয়ে যান। বাংলার ইতিহাসে দাঙ্গা আছে অনেক, জাতিগত ভেদাভেদও কম হয়নি, কিন্তু সব শেষে এটাও প্রতীয়মাণ হয়েছে যে, বাংলার সংস্কৃতিতে মৌলবাদ কখনওই জিততে পারেনি। বরাবর পরাস্ত হয়েছে।
এই ঘটনাই আমরা চাক্ষুষ করলাম বসিরহাটে। কবীর থেকে লালন, সুফি থেকে বাউল— বাংলার সংস্কৃতিকে একটি ‘মেল্টিং পট’ তৈরি করতে
সক্ষম হয়। আমরা এই দুই সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির বিরোধিতা করছি। আর সেই কারণে বিজেপি নেতাদের মনে হচ্ছে আমরা হিন্দু-বিরোধী হয়ে উঠছি। হিন্দু হতে গেলে অ-হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতা করতে হবে— এটাই হল আজ বিজেপির দর্শন।
এই দুই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেই আমাদের লড়তে হবে। দার্জিলিঙে বিচ্ছিন্নতার শক্তিকে সক্রিয় করে বাংলাকে ভাগ করার চেষ্টা তো চলছেই। এ বার শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার রাস্তায় হেঁটে বাংলাকে ভাগ করা। এখন তো দাঙ্গাও কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়। কম তীব্রতার দাঙ্গা। মনে পড়ে ভীষ্ম সাহনির তমস সিরিয়ালে ওম পুরীকে দিয়ে একটা শুয়োর মেরে মসজিদে ফেলার ব্যবস্থা করেছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদ। বসিরহাটের ঘটনাতেও বহিরাগতদের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে বাতি জ্বালানোর জন্য ত্রিফলা চালু করেছিলেন। বিজেপির এখন ত্রিফলা কৌশল— দার্জিলিঙের অশান্তির আগুনে বাংলাকে ভাঙো, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় বাংলাকে ভাঙো, সিবিআই নামক রাজনৈতিক অস্ত্র দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নেতাদের বধ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করো। আপাতত লক্ষ্য ২০১৯।
বিজেপিকে বুঝতে হবে, গোরক্ষক বাহিনীর সন্ত্রাসে হিন্দি বলয়ে ভোটের রাজনীতির ফসল তোলা সম্ভব। কিন্তু গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস থেকে নোয়াখালির দাঙ্গা— বাঙালি অনেক দেখেছে। তবু জিতেছে সম্প্রীতি। হিন্দি আর হিন্দু জাতীয়তাবাদ দিয়ে বাংলাকে ভাঙা এত সহজ নয়। তাই এত কিছুর পরেও বলব, বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy