ভগ্নশেষ: উনিশ শতকের ছিং সম্রাটদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, দ্বিতীয় আফিম-যুদ্ধে যা বিনষ্ট হয় ইউরোপীয় শক্তির হাতে, ১৮৬০। গেটি ইমেজেস
সাম্প্রতিক খবর, গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা কমেছে। আগের তুলনায় পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এখনও স্পষ্ট নয় কী কারণে ১৫ জুন-এর ওই সংঘর্ষ হয়েছিল। যেমন স্পষ্ট নয়, কোন শর্তে দুই দেশ একসঙ্গে তাদের সেনা সরিয়ে আনছে উপত্যকা থেকে। কিন্তু এর মাঝে, দুই দেশ যে চরম অবিশ্বাস ও সন্দেহের এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে, সেটা একেবারে পরিষ্কার।
এখন কথা হল, দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রেক্ষিত (যাকে বলে ‘লং দ্যুরে’) এই সংঘর্ষে ঠিক কোন মাত্রা যোগ করছে? মনে রাখা দরকার যে দু’পক্ষের সেনা মুখোমুখি হল এমন এক সময়ে যখন দুই দেশের বিদেশনীতি কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে। যদি আগের সব মতানৈক্য এবং সংঘর্ষ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের কারণে ঘটে থাকে, তা হলে ২০২০ সালের এই মুখোমুখি সেনা সমাবেশের ক্ষেত্রে কিন্তু অন্য একটি কারণকে প্রাধান্য দিতেই হবে— এথনো-ন্যাশনালিজ়ম বা নৃগোষ্ঠীভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নাটকীয় বাড়বাড়ন্ত।
গণপ্রজাতন্ত্রী চিন এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র, দুই দেশই দুই সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র। ভারতের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ও চিনের ক্ষেত্রে ছিং সাম্রাজ্য। শোষিত হওয়ার লম্বা ইতিহাস যেমন দুই দেশেরই রয়েছে, তেমন দুই দেশই এক সময় ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। আবার একই সঙ্গে, দুই দেশই স্বতঃস্ফূর্ত ও বাধাহীন ভাবে একটি ক্ষেত্রে তাদের পূর্বসূরিদের অনুগামী— ভূমি দাবির বিষয়ে।
আঠারো শতকের শেষের দিকে, আগেকার মিং সাম্রাজ্যের পুরনো অংশ, মাঞ্চুরিয়া, মঙ্গোলিয়া, শিনজ়িয়াং এবং তিব্বত জুড়ে বিস্তৃত ছিল ছিং সাম্রাজ্য। এর আকস্মিক পতন ঘটেছিল ১৯১১ সালে। এই দ্রুত পতনের অন্যতম প্রধান কারণ— সাম্রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান প্রজাদের মধ্যে এথনো-ন্যাশনালিজ়ম-এর জোরালো উত্থান। তাদের অনেকেই পশ্চিমি এবং জাপানি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে বার বার পরাজয়ের জন্য দোষারোপ করত মাঞ্চু শাসক গোষ্ঠীকে। ভবিষ্যতে চৈনিক জাতীয়-রাষ্ট্রের পরিধি কত দূর বিস্তৃত হতে পারে, সেই নিয়ে জোরালো তর্কবিতর্ক হত এই বিদ্রোহীদের মধ্যে। যেখানে হান-চিনা সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, ভবিষ্যৎ চিন কি শুধু সেই অঞ্চলগুলি নিয়েই তৈরি হবে? না কি তার মধ্যে জুড়ে যাবে অন্যান্য অঞ্চলও— আকারে বিরাট, কিন্তু তুলনায় কম জনবহুল শিনজ়িয়াং, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া এবং মাঞ্চুরিয়া? ক্রমে এই দুই স্বতন্ত্র চিন্তা মিলে একটি উদ্দেশ্যে পরিণত হল। পশ্চিমী সাম্রাজ্যগুলি রাজনৈতিক খণ্ডীকরণের বিরোধী, টুকরো টুকরো অঞ্চল তৈরি তাদের না-পসন্দ। চিনের নতুন শাসক গোষ্ঠীও মনে করল, সেটাই ভাল, কেবল নিজেদের পুরনো এলাকা নিয়ে কী হবে, তার থেকে চৌহদ্দির ধারেকাছে থাকা অঞ্চলগুলির দখল পেলে সাম্রাজ্যও বাড়বে, সম্পদও বাড়বে। ফলে ১৯১২ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নিল যে নতুন চিন প্রজাতন্ত্র, বিস্তারের দিক থেকে তা যেন অাঠারো শতকে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ছিং সাম্রাজ্যেরই প্রতিরূপ। পরবর্তী কালে, ১৯৪৯ সালে যখন চিনা কমিউনিস্ট পার্টি গৃহযুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে জয়ী হল, তখনও তারা চার দশক আগে যে রাষ্ট্রীয় ভূমি, সে বিষয়ে কোনও বদল আনার কথা ভাবলই না।
এ দিকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রিটিশরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে শাসন করছিল গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ, যা আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ হল ১৯৪৭ সালে। ১৯৩৭ সালে, ব্রিটিশ রাজের তুঙ্গ অবস্থায় মায়ানমার অঞ্চলও তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপমহাদেশ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলেও, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারত ও পাকিস্তান কিন্তু ব্রিটিশদের নির্ধারিত সীমারেখাকেই উত্তরাধিকারসূত্রে গ্রহণ করে নিল। স্বাধীনতার পরে ব্রিটিশদের অধিকারে থাকা ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে জোরদার প্রচার চালিয়েছিল ভারত। সীমান্তবর্তী এলাকা, যেমন, ভারতের উত্তর-পূর্ব এবং পাকিস্তানের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম রাজ্যগুলি সেই সময় স্বশাসন বা সরাসরি স্বাধীনতা দাবি করে। কেউ তাদের দাবি মানেনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ জম্মু ও কাশ্মীর (লাদাখ-সহ), যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন। এই অঞ্চল নিয়ে বিবাদের জেরে ক্রমে শুধু সেখানে একটা জোরদার ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ই গড়ে উঠল না— ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় চিরস্থায়ী শত্রুতা তৈরি হয়ে গেল তা নিয়ে। অঞ্চল ভাগাভাগির দিক দিয়ে শেষ উল্লেখযোগ্য পুনর্বিন্যাস ঘটল ১৯৭১ ও ১৯৭৫ সালে। ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে হল বাংলাদেশ। আর ১৯৭৫-এ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হল সিকিম।
সাম্রাজ্যবাদী উত্তরাধিকার বহনের এই প্রবণতাই চিন প্রজাতন্ত্র ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের উপরে চাপিয়ে দিল অচিহ্নিত সীমান্তের দায়। দেশের সীমান্ত বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার অবস্থান নিয়ে তাদের পরস্পরবিরোধী ধারণার উৎস তাই লুকিয়ে আছে উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ-ভারত ও ছিং (পরে চিন দেশ) এবং তিব্বতের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিভিন্ন বৈঠকের ভিতর। ১৯৬২-র যুদ্ধ-সহ ১৯৬৭, ১৯৭৫, ১৯৮৭ সালের ছোটখাটো সীমান্ত-দ্বন্দ্ব ঘটল কোনও গ্রহণযোগ্য ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারার ফলে।
নীতিগত, এমনকি আইনগত, দিক দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী দুই রাষ্ট্রই। তাদের কেউই আসলে সীমান্তবর্তী এলাকার উপরে কোনও অধিকার দাবি করতে পারে না। তাই বলা যায়, গত কয়েক দশকের প্রতিটি আঞ্চলিক বিবাদের মধ্যে লুকিয়ে থেকেছে এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি। ভারত ও চিন উভয়েই নিজেদের প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করলেও তাদের ভাবনার মধ্যে থেকেছে সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ।
১৯৪৯ সালের পরে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশের মানুষকে বোঝাত, দল এবং চৈনিক বিপ্লবের প্রতি অনুগত থাকা কত জরুরি। ১৯৮৯ সালে সেই ভাবনায় এল বদল, যখন সরকার দলের পরিবর্তে দেশের প্রতি আনুগত্যে নজর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ‘স্বাদেশিক শিক্ষা’ প্রচারের মতো নীতি গ্রহণ করা হল। ফল— সময়ের সঙ্গে ক্রমোত্থান হল এক জাতীয় অহঙ্কারদীপ্ত হান জাতীয়তাবাদের, যা সামান্যতম অপমানও সহ্য করতে রািজ নয়, তা সে অপমান সত্যি হোক, কিংবা কাল্পনিক হোক। প্রায় এক শতক আগে যে রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফলে ছিং সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল, এখনও েতমন। বর্তমান চিনের নানা দিকে এর ছাপ স্পষ্ট। বিশেষত শিনজ়িয়াং প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম উইঘুর মানুষদের যে ভাবে বিরাট শিবিরে অন্তরিন করে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করার চেষ্টা হচ্ছে— তার থেকে ভয়ানক আর কী-ই বা হতে পারে।
অন্য দিকে, ভারতের মাটিতে এথনো-ন্যাশনালিজ়ম-এর উত্থান ঘটছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি দলটির ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। আশির দশকে যে দলটির তেমন গুরুত্বই ছিল না, আজ তারাই দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক ভাবনার চালক ও বাহক। এদের বলিষ্ঠ উচ্চবর্ণ হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের সগৌরব প্রচারের সামনে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাষ্ট্রের ছবি ক্রমশই ফিকে। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির থেকেও আজ বিজেপি-র নথিভুক্ত সদস্যসংখ্যা বেশি। তার জোরেই তারা তাদের বিরোধী সব প্রাতিষ্ঠানিক বাধাকে সরিয়ে দিতে উদ্যত। শুধু তা-ই নয়। এ দেশের বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও এরা ধ্বংস করতে ব্যস্ত, নাগরিক সমাজের উপর আক্রমণে অবিশ্রান্ত।
ফলে সীমান্ত সমস্যা এখন শুধু আর আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিনের আত্মগর্বী হান জাতীয়তাবাদ, আর ভারতের মারমুখী হিন্দু জাতীয়তাবাদ। সীমান্তে সামান্যতম কোনও সমস্যাকেও নিজেদের সার্বভৌমতা আর আত্মাভিমানের প্রতি হুমকি বলে মনে করে দুই দেশ। সেনা জমায়েত বা সংঘর্ষের ক্ষেত্রে তাই বিপজ্জনক ভাবে উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কথাটা মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে।
মডার্ন চাইনিজ় হিস্ট্রি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy