Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

এ যেন ফাউ-ফুচকার দরাদরি

দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞেরা প্রায় সকলেই বরিসের এ-হেন জয়ের কারণ খোঁজায় একমত— ব্রেক্সিট। আগে তো ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছেদটা পাকাপাকি হোক, তার পর অন্য সমস্যার সমাধান করা যাবে! 

বরিস জনসন

বরিস জনসন

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০০
Share: Save:

বিলেতের প্রধানমন্ত্রী হলেন বরিস জনসন। এতটা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউই আন্দাজ করেননি; বিশেষত, কয়েক দশক ধরে লেবারের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু কেন্দ্রে কনজ়ারভেটিভ দলের জয় তো একেবারেই কল্পনার বাইরে ছিল। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞেরা প্রায় সকলেই বরিসের এ-হেন জয়ের কারণ খোঁজায় একমত— ব্রেক্সিট। আগে তো ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছেদটা পাকাপাকি হোক, তার পর অন্য সমস্যার সমাধান করা যাবে!

গত সাড়ে তিন বছরে বিলেতে ব্রেক্সিট নিয়ে ধানাইপানাই কম হয়নি। একদা জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার ভাষায় বললে, একের পর এক ‘তারিখেঁ’ শুধু মিলেছে; তবু এত নাটকের পরে হাতে পেনসিলও থাকেনি! ইউরোপের সঙ্গে কোনও চুক্তি বা সমঝোতা হয়নি, ব্রেক্সিটটাই আদৌ হবে কি না তার নিশ্চয়তাও গত মাস অবধি ছিল না। ঘুরেফিরে তিনটে অপশনে বিলেতের জনতা ও নেতারা আটকে থেকেছেন, ইউরোপের সঙ্গে কোনও ডিল বা চুক্তি হবে, বা, কোনও চুক্তি ছাড়াই ‘নো-ডিল-ব্রেক্সিট’ হবে, অথবা ব্রেক্সিটই হবে না।

তিনটে পরিণতিরই ভাল-মন্দ আছে; তিনটেরই পক্ষে-বিপক্ষে জনসমর্থনের অভাব নেই। সমস্যা মূলত দু’টি; প্রথমটা হল, সম্ভাব্য অজস্র ডিল-এর মধ্যে এমন একটা কিছু বেছে নিতে হবে যাতে দু’পক্ষই খুশি হন। আগের প্রধানমন্ত্রী টেরিজ়া মে ইউরোপের সঙ্গে পাকা ডিল করেও ভোটে তিন তিন বার গোহারান হেরে কাঁদতে কাঁদতে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘নো-ডিল’ বিলেতের পক্ষে কত খারাপ? এতে কি ইউকে’র সর্বনাশ হয়ে যাবে? ‘ব্যাড-ডিল’এর থেকে ‘নো-ডিল’ই কি ভাল নয়?

তর্কের শেষ নেই, তার উপরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারের মতো অনেকে মনে করেন ব্রেক্সিটটা না হলেই সবচেয়ে ভাল হয়। পুনরায় গণভোট ডাকা হোক, দেখা যাক, এ বার জনতার রায় কী হয়!

ঠাট্টা করে নিন্দুকেরা বলেন, হয়ে যাক—

আরও একটা কেন, ‘বেস্ট অব থ্রি’ বা ‘বেস্ট অব ফাইভ’-এর গণভোট হোক!

নির্বাচনে বরিসের জয়ে বোঝা গেল, আর যা-ই হোক, গণভোটের কোনও প্রশ্নই উঠবে না ব্রেক্সিটটা হবেই, আজ না হোক, কাল! তা হলে এ বারে হাতে রইল, ‘ডিল’ বা ‘নো-ডিল’। তবে, আগে জেনে নেওয়া ভাল কোন কোন বিষয়ে ‘ডিল’ হতে পারে। প্রশ্নটা মূলত অর্থনৈতিক। ব্রেক্সিটের পরে ইইউ-এর সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য, জিনিসপত্র কেনাবেচা ও শ্রমিকদের যাতায়াত মুক্ত বা অবাধে হবে কি না; এই প্রশ্নের নানান উত্তর হতেই পারে। সমস্যাটা বিলেতের ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় গম্ভীর, তার কারণ হল আয়ার্ল্যান্ড এবং উত্তর আয়ার্ল্যান্ড দেশ দু’টির ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থান। দেশ দু’টি পাশাপাশি, সীমান্তরক্ষার ঝামেলা এত দিন ছিল না; কিন্তু এখন ব্রেক্সিটের পরে এক দিকে আয়ার্ল্যান্ড ইউরোপের অন্তর্গত থাকবে কিন্তু উত্তর আয়ার্ল্যান্ড ইউকে-র অঙ্গ হিসেবে ইউরোপের বাইরে বেরিয়ে যাবে। অগত্যা বিলেতের সঙ্গে ইইউ-র চুক্তি এমন হতে হবে যা দুই আয়ার্ল্যান্ড মেনে নেবে এবং নিজেদের দ্বীপের মধ্যে তা কাজেও লাগাতে পারবে!

এখানেই সবাই এত দিন আটকে ছিলেন। তবে, সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে ইইউ নেতাদের সঙ্গে বরিস একটা ডিল করেছিলেন; সেটাই হয়তো এ বার সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে বরিস সহজেই পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নেবেন। আর তা যদি এত সহজে না মেটে, তা হলে আবার ঝকাঝকি, দরাদরি।

দরদাম বুঝতে আমরা বিলক্ষণ পারি। ফুটপাতের দোকানে কাঁচা হাতে লেখা ‘ফিক্সড প্রাইস’ বোর্ড ঝোলানো থাকলেও আমরা দমে যাই না। অনেক ক্ষেত্রেই দরদস্তুর করাই সার, শেষে কেনাকাটাটাই হয় না, হয়তো ক্রেতা হিসেবে আমাদের পোষায় না, অথবা বিক্রেতা হিসেবে দোকানদারের। সামনে হাঁটা লাগাই! কিছুটা এগিয়ে গেলে দোকানি হয়তো আমাদের পিছু ডাকেন, “দিদি আসুন, নিয়ে যান।”

রাস্তার ফুচকাওয়ালার কাছে ক’টা ফুচকা খেলে ক’টা ফাউ পাব, অথবা রামধনু-জোট হলে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের জন্য ক’টা আসন মিলবে, অথবা পৈতৃক সম্পত্তি বিনা-উইলে বাটোয়ারা হলে কোন সন্তান কত ভাগ পাবে, এ-সবই ঠিক হতে পারে ‘বার্গেনিং’-এর মাধ্যমে। বার্গেনিংয়ে ব্যক্তির সাফল্য নির্ভর করে পরিস্থিতির ভেতরের ও বাইরের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ের উপর; সাদা বাংলায় বললে, যার যত ‘বার্গেনিং পাওয়ার’ তার তত লাভ।

মানতেই হবে, বরিস এই ‘গেম’টা ভালই বোঝেন। খেলবেনও হয়তো ভাল! তিনি এখন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, তদুপরি হাতে আশিটা আসনের গরিষ্ঠতা। অতএব, শ্যাম রাখি না কুল, সেই সমস্যা তাঁর আর নেই। তার চেয়েও বড় কথা, ‘নো-ডিল’ নিয়ে তাঁর কোনও ছুতমার্গ নেই। নাই-মামা বা কানা-মামা কোনটা তাঁর কাছে ভাল সে কথা খোলসা করেননি। তাই, ওঁর সঙ্গে বার্গেনিং করতে গেলে নো-ডিল’কে সরিয়েও রাখা যাবে না। বেশি ঝামেলা করলে উনি ডিল ছাড়াই বেরিয়ে আসবেন।

মনে রাখা ভাল, নির্বাচনের আগে তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল ‘জিবিডি’— ‘গেট ব্রেক্সিট ডান!’ প্রতিশ্রুতি পূরণই তো সার লক্ষ্য, রাজনীতিতে।

অন্য বিষয়গুলি:

Britain Brexit Boris Johnson
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy