অছিপুর। ছবি: অরুণ লোধ
সাত বছর আগে কলকাতা থেকে আইবিস জাহাজের যে জলযাত্রা শুরু হয়েছিল, এত দিনে তা শেষ হল। আইবিস এখন আর দেহাতি কুলিদের নিয়ে মরিশাসে যায় না, এই ১৮৪১ সালে সে দাঁড়িয়ে আছে চিনের পার্ল নদীতে। তার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ৭৪ বন্দুকওয়ালা ওয়েলেসলি, ৪৪ বন্দুকের ড্রুইড, এই সব নানান যুদ্ধজাহাজ। যুদ্ধ মুক্ত বাণিজ্য ও মানুষের স্বাধীনতার জন্য।
নেশার হাত থেকে দেশ বাঁচাতে বছর দুয়েক আগে চিন স্বদেশে আফিম ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দাদন দিয়ে পোস্ত চাষ করায়, গাজিপুরে আফিম তৈরির বৃহত্তম কারখানা। কোম্পানির ব্যালান্স শিটের এক পঞ্চমাংশই আসে আফিম থেকে। আফিমের দর কত উঠছে, কত নামছে সেই সব স্পেকুলেশনের জন্য কলকাতায় তৈরি হয়েছে ওপিয়াম এক্সচেঞ্জ। অতএব ব্রিটিশ বণিকদের যুক্তি, ‘মাঞ্চু রাজাটা আমাদের মুক্ত বাণিজ্যের অধিকারে হাত দিচ্ছে। ব্যাটার অত্যাচারে এখানে লাখো মানুষ অনাহারে। তাদের বাঁচাতেই আমাদের যুদ্ধ।’ পুরনো আমলের দুর্বল চিনা যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশ আক্রমণের মুখে দাঁড়াতে পারল না, ‘রেড ইনসেন্স বার্নার হিল’ (লাল সুগন্ধি পোড়া পাহাড়’)-এর দ্বীপটা ছেড়ে দিতে হল ব্রিটিশদের হাতে। সাহেবরা তাকে বলে হংকং।
এই সব ঘটনা নিয়েই অমিতাভ ঘোষের নতুন উপন্যাস ‘ফ্লাড অব ফায়ার’। কলকাতায় আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হল শনিবার সন্ধ্যায়। সাত বছর আগে ‘সি অব পপিজ’ নামে বেরিয়েছিল আইবিস-ট্রিলজির প্রথম খণ্ড। মাঝে ‘রিভার অব স্মোক’। এ বার আফিম যুদ্ধের ক্লাইম্যাক্সে ট্রিলজির চূড়ান্ত পর্ব। ইরাক বা আফগানিস্থানে মার্কিন হামলার সঙ্গে ওই যুদ্ধের কোনও তফাত পাওয়া গেল না যে! বলতেই হাসলেন লেখক, ‘আর্কাইভে পুরনো বয়ানগুলি পড়তে পড়তে আমারও বার বার মনে হয়েছে, কোনও তফাত নেই।’
ট্রিলজির প্রথম পর্বে দেখা গিয়েছিল খিদিরপুরের চিনা মহিলা আশাদিদি ও তাঁর পরিবারকে। তাঁরা উৎসবের সময় বজবজের কাছে অছিপুরে যেতেন। এখন ক্যান্টন। শেষ পর্বে বিধ্বস্ত ক্যান্টন ছেেড় হংকং-এ। ‘এ বার ম্যাকাওতে এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলাম। তার মালিক চমৎকার বাংলা বলেন।’ ‘লুক ইস্ট’-এর যুগেও কলকাতা এই মাইগ্রেশনের ইতিহাস মনে রাখেনি। আশাদিদিদের অছিপুরই ভারতে প্রথম চিনা বসতি। চিনা বণিক তাং আছিউকে বার্ষিক ৪৫ টাকা খাজনায় বজবজের কাছে ৬৫০ বিঘা জমি দিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। আছিউয়ের নামেই অছিপুর। কলকাতার ঐতিহ্য বলতে আমরা কেবল চিৎপুর, জোড়াসাঁকো, শোভাবাজার ভাবি। ‘আমাদের ইতিহাস চেতনা তো বরাবর কম,’ বললেন লেখক।
মুক্ত বাণিজ্য এসেছিল, যথারীতি, স্কুনার, ফ্রিগেট ও নানা যুদ্ধজাহাজে চড়ে। উনিশ শতকের শুরুতেও কলকাতায় তৈরি হত নানা যুদ্ধজাহাজ। সে রকম এক জাহাজকে পুরোভাগে রেখেই রেঙ্গুন দখল করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এ বারেও কলকাতা থেকে চলল আইবিস, হিন্দ ইত্যাদি জাহাজ। চিনারা আশা করেছিল, ব্রিটিশদের জাহাজ পার্ল নদী বেয়ে বেশি দূর যেতে পারবে না। সেনাপতি ব্রেমারের বুদ্ধিতে প্রথমে অগভীর জলে চলতে পারে, এমন জাহাজ এগিয়ে গেল। হতভম্ব ভাব কাটার আগেই পিছনের জাহাজ থেকে আছড়ে পড়ল রকেট।
সবই কনগ্রিভ রকেট। মহীশূরের নবাব হায়দর আলি প্রথম ইংরেজ সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করতে রকেট ব্যবহার করেন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কনগ্রিভ তা থেকে আইডিয়া নিয়ে ক’বছর গবেষণা করে নিজের নামাঙ্কিত রকেট তৈরি করেন। অতঃপর সে ওয়াটার্লু থেকে আফিম যুদ্ধ সর্বত্রগামী। ‘ফ্লাড অব ফায়ার’-এর অন্যতম চরিত্র, বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির হাবিলদার কেশরী সিংহ আসাই-এর যুদ্ধে মরাঠাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। ‘কয়েক দিন পরেই ওয়াটার্লুর দুশো বছর। অনেক দামামা বাজবে। কিন্তু ডিউক অব ওয়েলিংটন নিজে বলেছিলেন, নেপোলিয়নকে হারানো নয়। তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন লড়াই ছিল আসাই।’
এখানেই শেষ খণ্ডের অগ্নিবন্যা। ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’-এ রুশ সেনা কী ভাবে নেপোলিয়নকে প্রতিহত করল, চমৎকার বর্ণনা আছে। ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ আজও বুঝিয়ে দেয়, প্রথম মহাযুদ্ধের পরাজয়কে জার্মান মন কেন মেনে নিতে পারেনি। স্পেনের গৃহযুদ্ধের পটে ‘ফর হুম দ্য বেল টোল্স’। ফাসিস্ত ফ্রাঙ্কোর বাহিনি যাতে না পৌঁছতে পারে, সে জন্য বুলেটবিদ্ধ হতে হতেও ডিনামাইটে ব্রিজ উড়িয়ে দেয় নায়ক! আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে দেশভাগ, দারিদ্র, প্রেম ইত্যাদি কচকচি যত হয়েছে, যুদ্ধ নিয়ে তার সিকিভাগও নয়। এখানেই অমিতাভ ঘোষের জিত! লেখক অবশ্য বলেন, ‘উপন্যাস ছাড়ুন। সামরিক ইতিহাস নিয়ে এ দেশে ক’জন ভাবেন?’ সামরিক ইতিহাসের দিক থেকেই নরেন্দ্র মোদীর চিন সফরে অন্য আলো দেখছেন তিনি, ‘‘মোদী চিনে এ বার যা বলেছেন, লাইন অব কন্ট্রোল ঠিক কোথায়, দুই দেশকেই ভেবে দেখতে হবে, এটা উল্লেখ্য প্রস্থানবিন্দু। চিন বরাবর প্রশ্নটা তোলে। আর ভারত এক কথা আউড়ে যায়। লাইন অব কন্ট্রোল কোথায় জানে না, এত দিনে স্বীকার করল ভারত।’’ ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানের দেশ অবশ্য উপন্যাসের এক জায়গায় চমকে যেতে পারে। যুদ্ধে হারলেও কয়েক দিনের মধ্যে চিনারা লম্বা ব্যারেলের বন্দুক বানিয়ে ফেলে। নতুন প্রযুক্তিকে তখন থেকেই ঝটিতি করায়ত্ত করে চিন।
বিদেশি আক্রমণ ও স্বদেশি দুর্নীতি। সম্রাটের আদেশে আফিম নিষিদ্ধ। কিন্তু জাহাজ থেকে স্মাগলাররা নৌকোয় করে আফিমের পেটি নিয়ে যায়। ক্যান্টনের নতুন শাসকের সঙ্গে তাদের দহরম-মহরম। পাশাপাশি আসেন মুক্ত বাণিজ্যের সেনানী বার্নহ্যাম সাহেব। সমরকর্তাদের ঘুষ দিয়ে সিপাহিদের জন্য নিম্ন মানের চাল, গম সরবরাহ করেন। বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রি ও মাদ্রাজ রেজিমেন্টের অর্ধেক সৈন্য, চিনাদের গুলিতে নয়, সেই নিম্ন মানের চাল গম খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
১৬০০ পৃষ্ঠার ট্রিলজি। কলকাতা, ক্যান্টন, ম্যাকাও, হংকং নানা জায়গা। সবই বাঁধা প়়ে়়়়়়়ড়ছে ইতিহাস আর রাজনীতির প্রবল বয়ানে। শেষ খণ্ডে ক্যান্টন আক্রমণের পর চিনা জনতা কোম্পানির বাণিজ্যসদর কোহং পুড়িয়ে দেয়। আফগানিস্থান, ইরাকের সঙ্গে মিল পেলেন বুঝি?
ইতিহাসের কত স্রোতেই যে ভেসেছে আইবিস! ওয়াটার্লুর দুশো বছর পূর্তির বছরে তার শেষ খণ্ডের প্রকাশ কাকতালীয়।
সেন্ট হেলেনায় বন্দি সম্রাট বলেছিলেন, বানিয়াদের জাত এখন চিনাদের আফিম গেলাচ্ছে, কিন্তু ওরা যে দিন জেগে উঠবে, অনেকের বিপদ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy