রাজ্যসভায় পাশ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির যুগলবন্দিতে গৃহীত একেকটি পদক্ষেপে বিরোধীরা পড়েছেন কার্যত উভয়সঙ্কটে। কখনও কখনও বিভিন্ন বিলের বিরোধিতা প্রসঙ্গে আক্রমণ শানাতে গিয়ে তাঁরা হয়ে পড়েছেন কার্যত দিশেহারা। কখনও বা হয়ে উঠেছেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিজেপি দলটির উল্কার মতো উত্থানের পিছনে রয়েছে যে মূল অস্ত্র, তা হল হিন্দুত্ব। এই হিন্দুত্বের অনুকূলসূচক হাওয়াকে সঙ্গী করে দেশের সংখ্যাগুরুর সমর্থনকে হাতিয়ার করে একের পর এক ভোট বৈতরণী পার করেই যাচ্ছে। শুধু তাইই নয়, ফলাফলের স্কোরবোর্ডেও অবলীলা ক্রমেই সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটছে উল্লেখযোগ্য হারে।
দেশের জনগণ বিজেপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে রূপান্তরিত করেছে। স্বভাবতই এই জয় মোদী-শাহের জুটিকে আরও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে এগোতে সাহায্য করেছে। মধ্যবর্তী সময়ে গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, রাভী, গোদাবরী, ব্রহ্মপুত্র দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছে অনেক জল। ঘটে গিয়েছে অনেক চমক। যেমন, স্বচ্ছ ভারত অভিযান, নোটবন্দি, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকট এয়ার স্ট্রাইক। আরও অনেক ঘটনাপ্রবাহ যা নিশ্চিত ভাবেই সমর্থন বাড়াতে সাহায্য করেছে তাঁদের দলকে। অন্তত ফলাফল তারই ইঙ্গিত করে। প্রথম চমক আসে নোটবন্দির মাধ্যমে, বিরোধীরা এর অর্থহীন প্রাসঙ্গিকতাকে উল্লেখ করে তাঁদের যখন প্রশ্নবানে বিদ্ধ করেন সংসদের উভয়কক্ষে, তখন মোদীজির একটাই সরল উত্তর— আপনারা কি চান না দেশের কালো টাকা উদ্ধার হোক? ব্যস, এটিএম-এ মানুষের দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ও ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে নোট পরিবর্তনের কষ্ট মুহূর্তে লাঘব।
দ্বিতীয় চমক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও বালাকটে এয়ার স্ট্রাইকের মাধ্যমে জঙ্গি নিধন। স্বাভাবিক ভাবেই দেশজোড়া জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া। একই সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস, যাক, চিরশত্রুকে শায়েস্তা করা গেল। বিরোধীরা এ বিষয়ে খানিকটা দিশেহারা। কারণ তাঁদের আক্রমণ শানানোর কোনও অস্ত্র নেই, যেখানে দেশের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন সবার আগে। তখন হাতে বিশেষ কোনও অস্ত্র না পেয়ে জঙ্গিনিধনের সত্যতা ও সংখ্যার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকলেন তাঁরা। জনগণ এই সব সন্দিগ্ধ তথ্য-পরিসংখ্যানের অবাঞ্ছিত কচকচানিকে বিশেষ আমল দিল না। তাদের কাছে এই সব ছুটকো বিষয় একপ্রকার ফুৎকারে উড়েই গেল জাতীয়তাবাদের সুড়সুড়ির কাছে।
গরমাগরম ফলও চলে এল হাতেনাতে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে একক ভাবে একেবারে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বসল বিজেপি। দেশের মানুষের আরও বিপুল মতদানের ফলে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর নতুন সরকার গঠনের পরেই ঘটাল আরও একটি বড় চমক। ৫ অগস্ট জম্মু-কাশ্মীর থেকে তুলে নেওয়া হলো ৩৭০ ধারা, সংসদের উভয় কক্ষেই বিলটি উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধীরা প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত শাহের সপ্রতিভ উত্তর— মজুদ ভারতীয় অখণ্ডতা রক্ষার্থে আপনারা কি চান না কাশ্মীর সম্পূর্ণ ভাবেই ভারতীয় সংবিধানের আওতাভুক্ত হোক?
রাম মন্দির নির্মাণের প্রশ্নেও উত্তর প্রস্তুত— আপনারা কি তা হলে রামের মতন ঐতিহাসিক চরিত্রের সত্যতাকে অস্বীকার করছেন? সংখ্যাগুরুর সেন্টিমেন্টে আঘাত হেনে কোনও বিরোধীই কি তার ভোট ব্যাঙ্ক খোয়াতে চায়? ফলত মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে যতই ভিন্নতার সুর থাকুক, সময়ের আবর্তে এ বিষয়ে আলোচনার যবনিকাপাত ঘটে যায়। এবং বিষয়টিও জনমানসের বিস্মৃতপ্রায় হয়ে উঠতে সাহায্য করল নাগরিকত্ব আইন।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (CAB) এরা যেন প্রায়ই অনেকটা একে অপরের পরিপূরকের ন্যায়। অসমে প্রথম এনআরসি-র প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ১৯ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। তার মধ্যে আবার সিংহভাগই হিন্দু, ফলে স্বভাবতই প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত হিন্দুদের মধ্যেও যেমন কিছু অংশের মনে সংশয়ের মেঘ আবর্তিত হয়েছে বা হয়ে চলেছে, অনুরূপে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রশ্নে মুসলিমদের মধ্যেও ঘনীভূত হয়েছে দ্বিগুণ সংশয়। অনুপ্রবেশ ও শরণার্থীর বিভেদরেখার জটিল হিসাবে সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার জোগাড়।
যার প্রতিফলনও দেখা গিয়েছে রাজ্যের বিগত তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে। ফলাফলের পর্যবেক্ষণে বিজেপিও বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। লোকসভায় অমিত শাহের বাংলাকে আলাদা ভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমেই এর গুরুত্বের উপলব্ধি হয়েছে। কারণ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এটা ভালই জানেন, নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে যে রাজ্যটি থেকে অধিক ফসল ঘরে তোলা যাবে, তা হল পশ্চিমবঙ্গ। হতে পারে, অবস্থার প্রেক্ষিত বিবেচনা করে এনআরসি-কে আপাত ভাবে সাইড বেঞ্চে সাময়িক ভাবে বসিয়ে, নাগরিকত্ব আইনকে ময়দানে নামানো হল। নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যাপারে যে অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, তাকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে।
এতে মোদী-শাহ জুটির যে অগ্রণী ভূমিকা, তা তাঁদের রাজনৈতিক ফায়দার লক্ষ্যে যে সুদূরপ্রসারী মাইলেজ এনে দেবে, এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। লোকসভায় বিল নিয়ে আলোচনা পর্ব চলাকালীন বিরোধীদের একের পর এক শাণিত ইনসুইং, আউট সুইং, রিভার্স সুইং, স্পিনের গুগলি সামলাতে সামলাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো একসময়ে খানিক মুখ ফস্কে বলেই ফেলেছিলেন বৌদ্ধের পরিবর্তে মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা। বিরোধীরাও সঙ্গে সঙ্গেই সেই বল লুফে নিয়ে বলেন মুসলিমদের কথা যখন বলেই ফেলেছেন তা হলে অবশ্যই বিষয়টি বিলে যোগ করুন। লোকসভায় কার্যত ওয়াক ওভার পাওয়ার পর রাজ্যসভাতেও ১২৫-১০৫ স্কোরে জয়লাভ করে তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপ্রতিরোধ্য দৌড়ের আইনি শংসাপত্র রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্পন্নও হয়ে গিয়েছে।
ব্যস, প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত অমুসলিম সম্প্রদায়ের (হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ) মানুষদের ক্ষতের মলম প্রস্তুত। অর্থাৎ, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সময়সীমার মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে আগত অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আপাত ভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস। নাগরিকত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে তাঁদের লাগবে না রেশন কার্ড বা বিশেষ কোনও প্রামাণ্য নথি। কিন্তু সংশয়ের ঘনীভূত কৃষ্ণমেঘ মসৃণ ভাবে সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত সুবিশেষ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। নাগরিকত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে তাঁদের পথ যেন অনেকটাই বন্ধুর। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হয়তো নাগরিকত্বের সেই বন্ধুর পথটি তাঁদের পার করতে হবে।
যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোকসভায় বিরোধীদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে বলেছিলেন— এই বিল ধর্মের নামে বিভাজনের জন্য আনা হয়নি। এই বিল ০.০০১ শতাংশও দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ঐতিহাসিক পশ্চাদপটকে এই প্রসঙ্গে টেনে এনে, বর্তমানে এই বিলের প্রাসঙ্গিকতার প্রয়োজনের জন্য মূলত কংগ্রেসকেই দায়ী করেন অমিত শাহ।
এ দিকে, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে অসম জুড়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। গুয়াহাটি থেকে বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে শহর ও শহরতলিতে। বিক্ষোভের আঁচে এ পর্যন্ত প্রাণ গিয়েছে পাঁচ জনের। সেই বিক্ষোভের তরঙ্গায়িত ঢেউ আছড়ে পড়েছে ত্রিপুরায়। অশান্ত অসমকে শান্ত করতে প্রধানমন্ত্রী টুইটে আশ্বস্ত করে বলেছেন— ‘‘সিএবি নিয়ে অযথা আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। কেউ আপনাদের অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না। কেন্দ্রীয় সরকার ও আমি আপনাদের রাজনৈতিক, ভাষাভিত্তিক পৃথক পরিচয়, সুন্দর সংস্কৃতি এবং জমির অধিকার নিয়ে সাংবিধানিক নিরাপত্তা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’’
রোজ কিছু না কিছু ঘটছে। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছি সে সব নিয়ে। আর এই সবের মাঝে দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলি চাপা পড়েই থাকছে। বেকারত্ব, নতুন শিল্প স্থাপন, অর্থনীতির মন্থরগতি, জিডিপি ক্রমশ নিম্নমুখী— এই সব মূল বিষয় অন্তরালে চলে যাচ্ছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের ও বৃহত্তম সংবিধানে বর্ণিত আছে— ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের প্রসঙ্গ। সুতরাং, সেই সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে তাকে অনুসরণ করাই বিধেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার যে বীজ প্রোথিত আছে আমাদের সংবিধানে, তার ঐতিহ্যের পরম্পরাকে আমরা ভুলে যাচ্ছি। ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’— এই আপ্তবাক্যই ভারতের চিরন্তন সুর। সেই মন্দ্রিত সুরের কোথাও যেন তাল কেটে গিয়েছে।
লেখক স্কুলশিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy