ছবি: কুনাল বর্মণ
বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রের সরকার এমন সব আইন প্রণয়ন করছে যার দ্বারা ভারতবর্ষ নামটির অপমান হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে এই মহান দেশ সর্বধর্মের মানুষকে এক সঙ্গে স্থান দিয়েছে নিজের মাটিতে। কবিগুরুর সেই ‘ভারততীর্থ’ কবিতাকে মিথ্যে করে দিয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ভারতবর্ষে প্রয়োগ করতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের মাটিতে গণহত্যা এবং যুদ্ধ চলেছে, তখন দলে দলে মানুষ পশ্চিমবাংলায় চলে এসেছেন এবং এই দেশ সেই সব আর্ত-উদ্বাস্তু মানুষকে উদারতার সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছে। ভারতবর্ষে সব ধর্মের মানুষ পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করেছে চিরদিন। আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরেও দেখেছি, দুর্গাপুজোয় নতুন জামা পরে আমাদের ইস্কুলের মুসলিম সহপাঠীরা পুজোমণ্ডপে এসে আমাদের সঙ্গে সন্ধ্যারতি দেখেছে। আমাদের সঙ্গে সেই সব মুসলিম বাড়ির ছেলেরা মণ্ডপে-মণ্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখে বেড়াচ্ছে। আবার ইদের সময়ে আমাদের তারা ডেকে নিচ্ছে নিজের বাড়িতে। তাদের মায়েরা আমাদের জন্য ফিরনি তৈরি করছেন। আর আমরা আনন্দ করে খাচ্ছি সেই ফিরনি।
হিন্দু এবং মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রে অবস্থিত বিজেপি সরকার। আমরা আমাদের ছোটবেলায় কখনও যা দেখিনি, এখন সেটাই দেখতে হচ্ছে। আমরা এখন দেখছি, রামনবমী উপলক্ষে এক দল মানুষ অস্ত্র হাতে মিছিল করছে। কিছু দিন আগে বিজেপি নেতা অমিত শাহ সভা করতে যখন পশ্চিমবঙ্গে এলেন, তখন অমিত শাহের সঙ্গে মিছিল করে আসা এক দল উন্মত্ত লোক বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে চুরমার করে দিল। আজ দেখছি, মুসলিম ধর্মাবলম্বী এক ব্যক্তিকে বিজেপি মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন— তোমাকে আগে ফেরত পাঠাই তোমার দেশে, তার পর তোমার কথার জবাব দেব।
এই ধরনের স্পর্ধা ভারতের জনগণ কখনও দেখেনি। এবং এই বিতাড়নের নীতি, আবারও বলছি, ভারতবর্ষকে অপমান করার নীতি। কোথাও আমরা ভুলে যাব না যে, আজ থেকে সতেরো বছর আগে গুজরাতে কী ঘটেছিল। ২০০২ সালে গুজরাতে চলেছিল অবাধ নরহত্যা এবং ধর্ষণলীলা। সেই সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র সেই দাঙ্গাকারীদের সমর্থনে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল এবং আক্রান্তদের বাঁচানোর জন্য কোনও রকমের চেষ্টা করেনি। সেই সতেরো বছর আগে দাঙ্গা কবলিত গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর নাম ছিল নরেন্দ্র মোদী। আজ কেন্দ্রে বিজেপি পরিচালিত যে সরকার প্রতিষ্ঠিত আছে, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নামও নরেন্দ্র মোদী।
ভারতবর্ষের মানুষ এনআরসি মেনে নেবে না, সিএএ মেনে নেবে না। এই সব অন্যায় আইন প্রণয়ন করার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আন্দোলন শুরু হয়েছে সারা দেশ জুড়ে। পশ্চিমবঙ্গেও এই আন্দোলন অত্যন্ত প্রবল এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কারণ এই আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এনআরসি চালু করতে গেলে তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে সে আইন চালু করতে হবে। এই দৃঢ় শপথ শুনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা ভরসা পাচ্ছি। কারণ বিজেপির সমস্ত অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের প্রধানতম বিরোধী মুখ হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কোনও ধরনের আস্ফালনে ভয় পান না। অথচ বিজেপি সরকার ভারতবর্ষের নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখতে চায় এবং নাগরিকের প্রতিটি নাগরিকত্ব অধিকারের অমর্যাদা করে।
তাই দিকে-দিকে আজ প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। এই দেশে, এই ভারতবর্ষে যেমন আমরা হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ সকলে এক সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে জীবনযাপন করেছি এত দিন— ভবিষ্যতেও তেমন ভাবেই বাঁচব। সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ যতই ছড়ানো হোক, তা কার্যকর হবে না।
এখন এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যখন রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে, ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে গিয়ে, ব্যক্তিগত অহংবোধ ভুলে গিয়ে সকলকে প্রতিবাদের মাটিতে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে।
সাহিত্যিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy