Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
বিজেপি কিন্তু গুজরাতে মেরুকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে

মেলাবেন তাঁরা, মেলাবেন?

কঙ্কালসার চায়ের দোকানটি যেন গ্রামের মুখ। পুরনো টায়ারের উপর সাজানো জলের কুঁজো আর দু’তিনটি খাটিয়া যার অলংকার।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০৪
Share: Save:

অমদাবাদ–বডোদরা এক্সপ্রেসওয়ে বরাবর গুজরাতের দক্ষিণে এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে দু’পাশের দিগন্ত তার শুখা পোশাক ছেড়ে ক্রমশ সুজলাং! আখ এবং কলার খেত— এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়! টোল প্লাজা পার হয়ে ঘন সবুজের কোল ঘেঁষেই ধূসর এক চায়ের ঠেক। পাশ দিয়ে রাস্তা ঢুকে গিয়েছে ভিতরের গ্রামে। এক্সপ্রেসওয়ে থেকে এক কিলোমিটার ভিতরে গ্রামের নাম লকোদরা।

কঙ্কালসার চায়ের দোকানটি যেন গ্রামের মুখ। পুরনো টায়ারের উপর সাজানো জলের কুঁজো আর দু’তিনটি খাটিয়া যার অলংকার। সেখানে গোটা দিনের হাহুতাশ, আমোদ, আড্ডা।

পথশ্রমের ধকল কমাতে হাতলবিহীন কাপে গুড়ের চা এল। কিন্তু নির্বাচনের মুখে দাঁড়ানো রাজ্যের হালচাল জানতে চাওয়ায় যা এল তার স্বাদ গুড়ের মতো বলা যাচ্ছে না।

‘‘এ গাঁয়ের বয়স না-হোক দুশো বছর। ক্ষত্রিয় এবং দলিত মিলেমিশেই থেকে এসেছে। আজও রয়েছে। কিন্তু পেটে দানাপানির এমন হাল কয়েকটা বছর আগেও ছিল না,’’ জানাচ্ছেন উদয় সিংহ। প্রাচীন দোকানি, মুখে বলিরেখার জ্যামিতি। কিছুটা আশঙ্কারও। কৃষি এবং খেতমজুরিপ্রধান এই গ্রামের বাসিন্দারা নাজেহাল বিভিন্ন দিক থেকেই।

খাওয়া সেরে দুপুরে মৌজ করতে আসা অন্য মুখগুলিও ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। ‘‘একে তো সরকার ফসল কেনার দর এত কমিয়ে দিয়েছে যে লাভের মুখই দেখতে পারছি না। নোটবাতিলের ধাক্কা সামলাতে পারিনি এখনও। মহাজনদের কাছে বাঁধা পড়ে রয়েছি। আবার জিএসটি শুরু হওয়ার পর মহাজনরা আগের চেয়ে কম দামে মাল নিচ্ছে। তাদের উপর নাকি করের চাপ বেড়েছে, সেটা পুষিয়ে নিচ্ছে আমাদের দিয়ে। বলুন, যাই কোথায়?’’ বলছেন রমেশ যাদব। যাওয়ার জায়গা যে বেশি নেই, চায়ের দোকানের জটলাকে পিছনে রেখে হেঁটে গ্রামে ঢুকলেই তা বোঝা যায়। সাইকেল-অসাধ্য রাস্তায় হাড়গোড়-ভাঙা ঘরদালান। বাঁশের খোঁটায় প্লাস্টিক ছাউনি দেওয়া গোশালায় মোষেদের মন্থর জাবর কাটা ছাড়া কোনও হেলদোল চোখে পড়ে না। একটা গ্রাম যেন রাতারাতি নিভে গিয়েছে।

চায়ের দোকান থেকেই সঙ্গ নেওয়া রমেশ জানাচ্ছেন, ‘‘জেগে থাকবে কী করে? মজদুরি তো বিলকুল খতম। দু’বছর হল পঞ্জাব থেকে হার্ভেস্টর নামের দানব ট্র্যাক্টর আসছে। অন্তত বিশ তিরিশ জন খেতমজুরের পনেরো-বিশ দিনের কাজ করে দিচ্ছে একটা যন্ত্র এক দিনে।’’ পঞ্জাবে ফসল কাটা এবং গোলায় তোলা হয় গুজরাতের মাস দেড়েক পরে। তাই বড় চাষি বা বেনামে জমি কিনে রাখা শিল্পপতি এবং রাজনৈতিক নেতারা পঞ্জাব থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসছেন এই হার্ভেস্টর। একলপ্তে খরচ পড়লেও, এক দিনে কাজ সারা হয়ে যাচ্ছে। এক মাস ধরে মজুরি গুনতে হচ্ছে না।

বডোদরার গ্রামটির উষ্মা আজকের গুজরাতের একটি খণ্ডবাস্তব। খণ্ড, কেননা সাবেক মহাজনীয় সংস্কৃতির এই রাজ্যের বাতাসে মিশে রয়েছে বহুস্তর উপাদান। জাতপাতের শাখাপ্রশাখা, শোষণ ও বঞ্চনা, রাজনীতিক ও বণিকের আঁতাঁত, মধ্যবিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ব্যবসামনস্কতা, উন্নয়নের টান।

সব মিলিয়ে ভোটের মুখে দাঁড়ানো গুজরাত যেন এক ভানুমতীর ক্যালাইডোস্কোপ! এক এক বার ঘোরান, পাবেন এক এক নকশা, এক এক চিত্রনাট্য, এক এক সম্ভাবনা। আর তাই ওই ধূসর চায়ের দোকান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে নিজের অটোর ভিতর আধশোয়া হয়ে নবনীত ঠাকোরের বক্তব্য এক্কেবারে ভিন্ন মেরুর। বললেন, ‘‘নিজে গাড়ি চালাই বলে বলছি না, মোদীজির আমলে এই সব রাস্তার যা উন্নতি হয়েছে তা ভাবনার বাইরে। ট্রান্সপোর্টাররা নির্ঝঞ্ঝাটে সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন।’’

আবার সুরাতের কাছে আদিবাসী গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের দীর্ঘশ্বাস শুনেছি। পাতিদারদের খেতে দৈনিক ১০০ টাকায় (গুজরাতের গড় খেতমজুরির থেকে অনেক কম) কাজ করেন তাঁরা, বহু জায়গাতেই ন্যূনতম খাবারটুকুও দেওয়া হয় না। শুনে প্রথমে একটু ধাঁধা লেগেছিল। দিল্লি থেকে শুনে এসেছি পাতিদারদের নেতা হার্দিক পটেল অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়ছেন। বিজেপি সরকারকে উৎখাত করতে মানুষকে একজোট করছেন। পাতিদার গোষ্ঠী তো এখন রাহুল গাঁধীর উজ্জ্বলতম তাস। অথচ এই আদিবাসী গ্রামগুলিতে তাঁরাই শোষকের ভূমিকায়?

ধন্দ কাটল পরে। চার দশক ধরে সামাজিক আন্দোলন এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন এনজিও-র নেতৃত্ব দেওয়া উত্তম পারমারের সঙ্গে কথা বলে। হার্দিক যে বিশেষ পাতিদার সম্প্রদায়টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু তাঁরাই পাতিদার তথা পটেল সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধি নন। পটেলদের মধ্যে রয়েছে দুটি পৃথক শ্রেণিচরিত্র। কাড়বা এবং লেওবা। সংক্ষেপে বললে, ‘কাড়বা’ পটেলরা অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল। পটেলদের জন্য তৈরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। গুজরাতের উন্নয়ন-প্রদীপের নীচে অন্ধকার ছায়ার মতো পড়ে রয়েছেন এঁরা। এঁদের আক্রোশকে একজোট করতেই গুজরাতে গত কয়েক মাস চরকি পাক মারছেন হার্দিক। সাড়াও মিলছে।

পটেলদের অন্য অংশটি বড় জমির মালিক। বাইশ বছরে বিজেপি শাসনে এঁরা পুষ্ট হয়েছেন। তাঁরা স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান থেকে বিধায়কদের তুষ্ট রাখার ক্ষমতা ধরেন। বিনিময়ে পান সমস্ত সুযোগসুবিধা। এঁরাই কম মজুরি দিয়ে আদিবাসীদের খেতে শ্রমদানে বাধ্য করেন, দলিতদের নিপীড়ন করেন। এঁরাই শহরে হাউজিং কমপ্লেক্সগুলিতে মাটরি ঝুলিয়ে মুসলিমদের জন্য প্রতীকী নিষেধাজ্ঞা টাঙিয়ে দেন। খুশি থাকেন শাসকগোষ্ঠী। শাসক খুশি থাকলে আরও বাড়ে এই ধনী পটেলদের সম্পদ। সমৃদ্ধ হয় গুজরাতের উন্নয়নের মডেল।

এ বারে ভোটের লড়াইয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ, সামন্তবাদ আর পুঁজিপতিদের নিয়ে তৈরি সনাতন মঞ্চটিকে অটুট রেখে শাসক দল এক দিকে চেষ্টা করছে হিন্দুত্বের ব্র্যাকেটকে আরও প্রসারিত করতে। মেরুকরণের তাস খেলে, অনগ্রসর শ্রেণি, দলিত, আদিবাসী, মধ্যবিত্ত পটেলদের হিন্দুত্ববোধ জাগ্রত করে, তাদের বর্গীয় অস্মিতাকে উসকে দিতে। অন্য দিকে রাহুল চেষ্টা করছেন জাতিধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে বিভিন্ন বর্গের উষ্মাকে ভোটের বাক্সে আছড়ে ফেলতে। তাঁর চ্যালেঞ্জ, বহু ক্ষেত্রে পরস্পর-বিবদমান গোষ্ঠীকে এক মঞ্চে নিয়ে আসা।

বডোদরার বিষণ্ণ গ্রামটিকে পিছনে ফেলে চাবুকের মতো পিচ্ছিল (যার ১ কিলোমিটার অন্তর বহুজাতিকের হোর্ডিং, ফুড পার্ক, ফিল্ম সিটি-র ছয়লাপ) এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগোতে এগোতে মনে হচ্ছিল সেই ক্যালাইডোস্কোপটির কথাই। যে নির্বাচনকে আগামী লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল হিসাবে দেগে দেওয়া হয়েছে, এমন বহুস্তরীয় জটিলতা তাকে মানায় বইকি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE