ছবি: সংগৃহীত
তামিলনাড়ুর সেই প্রতারক যুবক রমর পিল্লাইকে মনে আছে, যে একদা ভেষজ পেট্রোল আবিষ্কারের দাবি করে উঠে এসেছিল সংবাদ শিরোনামে? তার আবিষ্কারের চমৎকারিত্বে অভিভূত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ভেষজ পেট্রোল তৈরির কারখানার জন্য জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফর্মুলা চুরি যাওয়ার ভয়ে রমরকে দেওয়া হয়েছিল দু’জন সশস্ত্র দেহরক্ষীও। পরে চেন্নাইয়ের আইআইটিতে একদল বিজ্ঞানীর সামনে রমর তার আবিষ্কৃত পেট্রোল তৈরির পরীক্ষা দিতে গিয়ে ডাহা ফেল করে। ধরা পড়ে যায় তার বুজরুকি। তার পরে ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সবাইকে অবাক করে দিয়ে যখন দিল্লি থেকে অমৃতসর পর্যন্ত শতাব্দী এক্সপ্রেসে ব্যবহার করা হয়েছিল বায়োডিজেল, তখনও অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই। সারা বিশ্বেই আগামী দিনে জ্বালানি ক্ষেত্রে আশা ভরসা হতে চলেছে বায়োডিজেল, সম্ভাবনা যার অপার। পূর্বে বায়োমাস ও বায়োগ্যাসকে জ্বালানি হিসাবে সরাসরি ব্যবহার এবং তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারণা থাকলেও তা কিন্তু দূষণমুক্ত ছিল না। তাই বিকল্প জ্বালানি হিসাবে বায়োডিজেলের ব্যবহার বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য যা আগামী পৃথিবীর স্বাস্থ্যকেও সুরক্ষিত করবে। তা হলে এই বায়োডিজেল বস্তুটা আসলে কী?
বায়োডিজেল একটা জৈব জ্বালানি যা গাছ থেকে পাওয়া যাবে। যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন তাঁরা বলবেন, এ আর নতুন কথা কী, তরল সোনা পেট্রোলিয়ামও তো জৈব জ্বালানি, বায়োডিজেলের সঙ্গে তার তফাৎ কোথায়? তফাৎ অবশ্যই আছে এবং সে তফাৎ এতটাই বেশি যে বিজ্ঞানীরা এই নতুন বায়োডিজেলের পরীক্ষামূলক সফল ব্যবহারে রীতিমতো উৎফুল্ল। ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক।
পেট্রোল জৈব জ্বালানি হলেও প্রকৃতিতে এর পরিমাণ সীমিত। অতি ব্যবহারে দ্রুততার সঙ্গে ফুরিয়ে আসছে তরল সোনার ভাণ্ডার। নতুন বায়োডিজেল সেই সম্ভাবনা থেকে মুক্ত। চাষ করে জোগান দেওয়া যাবে এই ডিজেল, অর্থাৎ কিনা এই জ্বালানি উৎসটি নবীকরণযোগ্য। উন্নত দেশগুলোতে বায়োডিজেলের ব্যবহার কিন্তু একেবারেই নতুন নয়। ইউরোপ, আমেরিকায় খনিজ তেল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাপক হারে তৈরি হচ্ছে বায়োডিজেল। আর বায়োডিজেল তৈরির কাজে ব্যবহার করছে আমাদের অতি পরিচিত ভোজ্যতেল রেপসিড। আমাদের দেশে অবশ্য ভোজ্য তেলের ঘাটতি এতটাই যে রেপসিড দিয়ে বায়োডিজেল তৈরির ব্যাপারটা বিলাসিতা হয়ে দাঁড়াবে।
বিদেশে বায়োডিজেলের সফল ব্যবহার দেখে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা ওই রকম একটা তৈলবীজ খুঁজছিলেন যা একইসঙ্গে দামে সস্তা এবং সহজলভ্য হবে। শেষতক খোঁজ মিলেছে সেই বহু আকাঙ্খিত গাছটির। জানা গিয়েছে, আমাদের সুপরিচিত ভ্যারেন্ডা (বাগ ভ্যারেন্ডা বা সাদা ভ্যারেন্ডা) গাছের বীজের তেলেই রয়েছে বায়োডিজেলের অপার সম্ভাবনা।
গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Jatropa Curcus Linn. অনুর্বর রুক্ষ পোড়ো জমিতে এই গাছ জন্মে থাকে। কোথাও কোথাও বেড়া দেওয়ার কাজে গাছটির ব্যবহার দেখা যায়। কচিডাল ব্যবহৃত হয় দাঁতন হিসেবেও। ওষধি হিসাবেও রয়েছে এই গাছের ব্যবহার। কটুস্বাদযুক্ত রসের জন্য গরু-ছাগলও এ গাছ খায় না। উচ্চতায় গাছটি প্রায় ৮-১০ ফুট হয়ে থাকে। বর্ষাকালে গাছে ফুল ধরে। এর পরে সবুজ থোকা থোকা ফলে গাছ ভরে যায়। গাছেই ফল শুকিয়ে হলুদ হয় এবং ঝরে পড়ে। প্রতি ফলে তিনটি বীজ থাকে যাতে ৩০-৪০ শতাংশ তেল থাকে। অনেক ভোজ্য তেল থেকেই বায়োডিজেল তৈরি করা সম্ভব হলেও সেই সব তেলের কিছু ভৌত ধর্ম, উপাদানগত বৈশিষ্ট্য এবং অত্যধিক ঘনত্বের জন্য আধুনিক ইঞ্জিনে ব্যবহার করা অসুবিধাজনক।
সে দিক থেকে ভ্যারেন্ডা বীজের তেলের ফ্যাটি অ্যাসিড উপাদানগুলো ও তাদের ভৌত রাসায়নিক ধর্ম বায়োডিজেল তৈরির ক্ষেত্রে প্রায় আদর্শ স্বরূপ। এর পিচ্ছিলতা গুণ লুব্রিকেন্টের কাজ করে ইঞ্জিনের আয়ুও বৃদ্ধি করে। বীজতেলগুলো আসলে নানা অনুপাতে মিশে থাকা নানা ধরনের ট্রাইগ্লিসারাইড অণুদের মিশ্রণ। গ্লিসারিনের ফ্যাটি অ্যাসিড ট্রাইএস্টার এই ট্রাইগ্লিসারাইডগুলো। একটি গ্লিসারিন অণুর সঙ্গে তিনটি ফ্যাটি অ্যাসিড অণুর এস্টার বন্ধনীর ফলে তৈরি হয় এরা। এই ট্রাইগ্লিসারাইডের মিশ্রণ থেকেই ট্রান্সমিথাইলেশন পদ্ধতিতে তৈরি হয় বায়োডিজেল। রাসায়নিক বিক্রিয়ার জটিলতায় না গিয়ে সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, অনুঘটকের উপস্থিতিতে বীজতেলের সঙ্গে মিথাইল অ্যালকোহলের বিক্রিয়ায় পাওয়া যায় মিথাইল এস্টার আর গ্লিসারিন।
এই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত মিথাইল এস্টারই অতি কাঙ্খিত বায়োডিজেল। প্রতি লিটার বায়োডিজেল তৈরি করতে খরচ পড়ে মোটামুটিভাবে ১২ থেকে ১৫ টাকা যা ডিজেলের চলতি দামের থেকে অনেক কম। অব্যবহৃত পতিত জমির সদ্ব্যবহার করা যায় ভ্যারেন্ডা চাষের মাধ্যমে। বায়োডিজেল চাষ পরিবেশকে নির্মল করে। বায়োডিজেলে নেই সালফার বা অ্যারোসেটিকস্। এতে অক্সিজেনের উপস্থিতির জন্য জ্বালানির দহন আরও ভাল ভাবে হতে পারে। সাধারণ পেট্রোলে পাঁচ শতাংশ ইথেন মিশিয়ে তাকে সীসামুক্ত করা হয়। সাধারণ ডিজেল বায়োডিজেলে মেশালেও তা সীসামুক্ত হবে। ফলে কমবে দূষণ। সাধারণ ডিজেল পোড়ার সময় অসম্পূর্ণ দহনের ফলে যে অদগ্ধ হাইড্রোকার্বন, কার্বন মনোক্সাইড বা কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসৃত হয় বায়োডিজেল ব্যবহারে তা কমে আসবে লক্ষ্যণীয় ভাবে। ভ্যারেন্ডা বীজের তেল বহু প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ওঠাপড়া আজ অনেক দেশেরই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। বিশ্বের তেলভাণ্ডারগুলো নিজেদের তাঁবে আনতে যুদ্ধবাজ দেশগুলো আজ হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে বায়োডিজেল আশীর্বাদস্বরূপ।
বায়োডিজেলের ব্যবহারে শুধু যে বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হবে তাইই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ওঠাপড়া যে ভাবে আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছে তারও মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। উপরিপাওনা হিসাবে পাওয়া যাবে নির্মল পরিবেশ আর বাড়বে কর্মসংস্থান। আমাদের মতো বেকার জনবহুল দেশের পক্ষে বায়োডিজেল তাই এক আশীর্বাদ। ছবি: প্রতীকী
লেখক শিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy