সমাবেশ: বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে আয়োজিত বামপন্থীদের জনসভা। সমস্তিপুর, ২৭ অক্টোবর ২০২০। পিটিআই
ভোটের অঙ্ক দিয়ে সরকার গড়া হবে, এটা নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রাথমিক নিয়ম। এর ফলে একটা মুশকিল হয়েছে এই যে, নির্বাচনের আলোচনাটা সাধারণত ওই প্রাথমিক নিয়মের গণ্ডি উতরে আর বেরোতে পারে না। এই পাটিগণিত-চর্চা জরুরি। পরিসংখ্যানের আরও গভীরে নেমে বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু ভোটের অঙ্ক আর ভোট এক নয়। পরিসংখ্যানে আমরা নির্বাচনের পরিণামটুকু দেখি; প্রত্যেকটা নির্বাচনের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত থাকে, নিজস্ব প্রক্রিয়া থাকে, যাকে শুধু সেই পরিণাম দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। বিশেষত সেই পরিপ্রেক্ষিত ও প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যখন একটা বড় সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং দানা বাঁধে, তখন সেই নির্বাচনের সামগ্রিক পরম্পরার দিকে মন দিতে পারলে সে এমন অনেক কথা বলে, যা কোনও অঙ্কে ধরা পড়ে না।
যেমন বিহারে এ-বারের বিধানসভা নির্বাচন। তার ফলাফলের সংখ্যাগুলো অবশ্যই অর্থবহ। কিন্তু এই নির্বাচনের তাৎপর্য আরও অনেক বেশি গভীর ও সুদূরপ্রসারী। ভারতের নির্বাচনী (এবং বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক) মানচিত্রে বিহার বরাবরই অনন্য, সে-কথা মনে রেখেও বলতেই হবে, এ-বার সেই রাজ্যে একটি ইতিহাস রচিত হল। সম্ভাবনা সৃষ্টির ইতিহাস। রাজনীতি নির্মাণের সম্ভাবনা। অনুশীলনের মধ্য দিয়েই সেই নির্মাণ সম্ভব। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতির অনুশীলন দেখা গেল, ভোটের হিসেবে তার আংশিক ছবিই মেলে, তার বেশি নয়।
একটা স্তরে এই অনুশীলনের স্বরূপ একটি স্লোগানেই প্রতিফলিত। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মঞ্চ থেকে ধ্বনিত সেই স্লোগানের অর্থ: রোজগার, লেখাপড়া, ওষুধপত্র, সেচের জল। আরজেডি তথা মহাগঠবন্ধন নামক বিরোধী জোটটি জনসাধারণের এই মৌলিক প্রয়োজনের দাবিগুলি নিয়ে প্রবল প্রচার চালিয়ে শাসক গোষ্ঠীর মন্দির-মসজিদ-মার্কা রণকৌশলে বড় ধাক্কা দিয়েছিল, যে ধাক্কা সামলানোর তাগিদে প্রধানমন্ত্রীকে বিহারবাসীর উদ্দেশে আবেগ-আকুল চিঠি লিখতে হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে আকুলতর আবেগে বলতে হয়: ‘এই আমার শেষ নির্বাচন’, এবং শুধু ফাঁকা আবেগে চিঁড়ে ভিজবে না জেনেই তাঁরা বিপুল কর্মসংস্থান থেকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন, নানান প্রতিশ্রুতি বিতরণে বাধ্য হন। ভোটের বাজারে প্রতিশ্রুতি নেহাতই মামুলি ব্যাপার, কিন্তু প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির চাপে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর বাহিনী হিন্দুত্ব ছেড়ে চিঁড়ে ভেজানোর অন্য উপকরণ খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন, সেটা কম কথা নয়। নির্বাচনী রাজনীতির ময়দানে কী নিয়ে কথা হবে এবং কী সুরে তা বলা হবে, সেটা বেঁধে দিয়েই ওঁরা অর্ধেক যুদ্ধজয় সেরে ফেলতে তৎপর থাকেন। গত লোকসভা নির্বাচন তার সবচেয়ে প্রকট, এবং উৎকট, প্রমাণ। কিন্তু বিহারে তাঁরা নিজেদের অ্যাজেন্ডা বহাল রাখতে পারেননি, কার্যত মধ্যপথে বিরোধীদের তৈরি করে দেওয়া খেলায় যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। রাজনীতির নির্মাণে এর মূল্য বিস্তর।
কিন্তু এ কেবল সাম্প্রদায়িকতা থেকে উন্নয়নের স্লোগানে উত্তরণের ব্যাপার নয়, উন্নয়নের একটা নতুন অর্থ সন্ধানের অনুশীলনও বটে। বিহারে তার বাড়তি গুরুত্ব ছিল এবং আছে, কারণ নীতীশ কুমার উন্নয়নের ধ্বজা উড়িয়েই ক্ষমতায় আসেন এবং বহাল থাকেন, সেই ধ্বজাটিকে প্রধানমন্ত্রীও প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে তৎপর থেকেছেন। সুতরাং বিরোধী রাজনীতির অনুশীলনে উন্নয়নের বিকল্প ধারণার প্রয়োজন সমধিক। সেই অনুশীলন বিশেষ ভাবে সম্ভব হয়ে উঠেছে বিরোধী মহাজোটের শরিক হিসেবে বামপন্থীদের উপস্থিতিতে এবং তাঁদের টানে। মনে রাখতে হবে, বিহারে বামপন্থী দলগুলি, বিশেষত সিপিআই (এমএল)-লিবারেশন দীর্ঘ দিন ধরে মাটি কামড়ে তাদের রাজনীতির লড়াই চালিয়ে আসছে, শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার মৌলিক সংগ্রামই তাদের শক্তির উৎস, সংগঠনের প্রকরণ। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, বাস্তব পরিস্থিতির নির্দেশে এই বামপন্থীদের রণনীতির বিবর্তন ঘটেছে। নির্বাচনে একক লড়াইয়ের পথ ছেড়ে তাঁরা এ-বার জোটবদ্ধ হয়েছিলেন। জোটের প্রয়োজন যেমন সঙ্ঘ পরিবারের সর্বগ্রাসী অভিযানকে প্রতিহত করার জন্য, তেমনই দরিদ্র জনসাধারণের জীবনসংগ্রামকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য। দু’টি লক্ষ্য বিচ্ছিন্ন নয়— শ্রমজীবী মানুষকে তাঁদের বুনিয়াদি স্বার্থের ভিত্তিভূমিতে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলে কর্পোরেট পুঁজির পরম মিত্র এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যথার্থ মোকাবিলা অসম্ভব।
আরজেডির নেতা ও কর্মীদের কৃতিত্ব এইখানে যে, তাঁরা এই সত্যটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের পরিচিতির রাজনীতিকে শ্রমজীবীর শ্রেণি-রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। সেই সমন্বয় সম্পূর্ণ হয়নি, সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। এক নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই তাকে এগোতে হবে, এগোতে হবে চড়াই-উতরাইয়ের পথে। কখন ভোটের অঙ্কে সেই অগ্রগতির কত শতাংশ ধরা পড়বে, সেটাও অনিশ্চিত, কারণ সেই অঙ্কে অন্য হাজারটা বিষয়ের প্রভাব থাকে। কিন্তু ভিত্তিভূমিটাকে ঠিক রাখতে পারলে প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির অনুশীলন জারি থাকবে, তার নির্মাণও থামবে না। বিহারে সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতিহাস এই ভাবেই তৈরি হয়। হয়ে চলে। নির্বাচন ইতিহাসের একটি মুহূর্ত। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, কারণ সে ইতিহাসের অবয়বে জোরালো আলো ফেলে। সামনের পথটাতেও সেই আলো পড়ে, পথের একটা আভাস পাওয়া যায়।
বিহার থেকে কিছু আলো এসে পড়ছে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গেও। আমরা তাকে কাজে লাগাব কি না, সেটা আমাদেরই বিচার্য। বিহারের বামপন্থীরা একটা সোজা কথা সাফ সাফ বলেছেন: ভারতে, এবং পশ্চিমবঙ্গেও, বিজেপিই বামপন্থীদের এক নম্বর প্রতিপক্ষ। এই রাজ্যে এ-কথার তাৎপর্য স্পষ্ট। নির্বাচন যত কাছে আসবে, সেই তাৎপর্য ততই গুরুতর আকার ধারণ করবে। প্রধান প্রতিপক্ষ বেছে নেওয়ার প্রশ্নে সওয়াল-জবাব উত্তরোত্তর জোরদার হবে। কেবল বামপন্থীদের মধ্যে নয়, বৃহত্তর জনসমাজেও। সেই আলোচনার বেশির ভাগটা এখনও যে খাতে বইছে, তাতে রাজনৈতিক বোধের মাত্রা কম, ক্ষুদ্রস্বার্থের হিসেবনিকেশই প্রবল। ক্ষুদ্রবুদ্ধিরও। ‘আগে ওদের এনে এদের তাড়াব, তার পর ওদের তাড়াব’, এমন বিচিত্র তত্ত্ব যাঁরা আওড়াচ্ছেন তাঁদের আত্মঘাতী নির্বুদ্ধিতার (বা দুর্বুদ্ধির) কথা বাদই দেওয়া গেল, কিন্তু তার বাইরেও অনেকেই নাকি বিভ্রান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত। সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্য কী সেটা না-জানার কারণ এমনিতেই ছিল না, তদুপরি এত দিন ধরে মোদী জমানার নিরাবরণ মূর্তি দেখার পরেও এই বিভ্রান্তি কোথা থেকে আসে, বিশেষত নিজেদের যাঁরা বামপন্থী মনে করেন তাঁরা কী করে এমন দ্বিধার শিকার হন, সে বড় বিস্ময় বটে।
কিন্তু বিস্ময় পথ দেখাবে না। পথের সন্ধান করা দরকার। চোখ এবং কান বন্ধ না রাখলে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কারণ নেই যে, প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি নির্মাণের কাজটি পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োজনীয়। এবং অবশ্যই সম্ভব। বিপন্ন অর্থনীতি সে প্রয়োজন বাড়িয়ে তুলেছে, একই সঙ্গে বাড়িয়ে তুলেছে তার সম্ভাবনাকেও। রোজগার, লেখাপড়া, ওষুধপত্র, সেচের জল এবং এমন আরও নানান প্রয়োজনকে ঘিরে, সেগুলি পূরণের দাবিকে ঘিরে যে রাজনীতি গড়ে তোলা যায়, সেটাই পশ্চিমবঙ্গকে তার ক্ষুদ্রতার আবর্ত থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে, সে-পথে নিয়ে যেতে পারে। এই রাজনীতি অবশ্যই নানা ক্ষেত্রে নানা ভাবে রাজ্যের শাসকদের কাছে দাবি জানাবে, তাঁদের ব্যর্থতার সমালোচনা করবে, অনাচারের প্রতিবাদ করবে। সেই প্রতিস্পর্ধার লক্ষ্য হবে শ্রমজীবী মানুষের যথার্থ উন্নতি। বৃহৎ অর্থে শ্রমজীবী মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই সৃষ্টিশীল রাজনীতিই হয়ে উঠতে পারে অসহিষ্ণু ও বিষাক্ত সংখ্যাগুরুবাদের যথার্থ প্রতিষেধক, তার বিধ্বংসী বিদ্বেষকে প্রতিহত ও পর্যুদস্ত করার সার্থক প্রকরণ। পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব বামপন্থীদেরই। কেবল বামপন্থী দলের নয়, বৃহত্তর বামপন্থী সমাজের। কিন্তু সে-দায়িত্ব পালনের জন্য মানুষের কাছে যেতে হবে, তাঁদের কথা শুনতে হবে, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে— সর্বজ্ঞতার উচ্চাসন থেকে নয়, সংগ্রামী রাজনীতি নির্মাণের সৎ এবং আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। ভোটের অঙ্কেও তার প্রতিফলন ঘটবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আগে সে-অঙ্কের মোহজাল ছেড়ে বেরোতে হবে। তা না হলে রাজনীতির যথার্থ নির্মাণ সম্ভব নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy