Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Bengali New Year

যে দিন সুস্থ আকাশের নীচে সমবেত প্রশ্বাস নিতে পারব, সে দিনই পয়লা বৈশাখ

পয়লা বৈশাখকেও নিশ্চয়ই মনে রাখব আমরা। যদিও, অস্বীকার করবার কোনও প্রশ্নই নেই যে, মনখারাপ একটা হবেই হবে। 

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

শ্রীজাত
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২০ ২১:১৭
Share: Save:

কখনও এমন মন নিয়েও পয়লা বৈশাখের লেখা লিখতে বসতে হবে, এ আমার সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না। অবশ্য যে-সময়ের মধ্যে দিয়ে, বা বলা উচিত যে-দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, তা নিশ্চিত কারও কল্পনাতেই ছিল না। আমরা অনেকেই নিশ্চয়ই গোড়ার দিকে বেশ আশাব্যঞ্জক ছিলাম এই ভেবে যে, এ পৃথিবী কত কিছু সহ্য করেছে, এ আর এমন কী। কিন্তু দেখতে দেখতে ক’দিনের মধ্যে গোটা পৃথিবীই যে বন্দি অবস্থায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় প্রহর গুনবে, এমন ধারণা আমাদের অনেকেরই ছিল না। অবশ্য, ভুল থেকে গেল একখানা, আগের বাক্যে। গোটা পৃথিবী নয়, কথাটা হবে, সমগ্র মানব-পৃথিবী। আমরা তো আমাদের বাইরে খুব একটা তাকিয়ে দেখতে শিখিনি, তাই মানুষের সঙ্কটকেই পৃথিবীর সঙ্কট বলে দাগিয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য আমাদের মজ্জাগত। আসলে তো পৃথিবীর অনেক কিছু মানুষের এই বন্দিদশার সুফল ভোগ করছে এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীও সেই হিসেবের আওতায় পড়ে। হ্যাঁ, আমরা স্থাণুবৎ হয়ে গিয়েছি প্রায়, সে-অবস্থার জের কবে কাটবে, কে জানে।

পয়লা বৈশাখকে কি আলাদা করে চিনতে পারব আর এ বার? জানি না। হয়তো কিছুটা পারব, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে, যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষজন চেষ্টা করছেন অবসাদের হাত থেকে অন্যদের সরিয়ে রাখার, যেখানে গান গেয়ে, কবিতা পড়ে, এঁকে, আরও কত রকম ভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষজনকে একটুখানি চাঙ্গা করার ব্রত নিয়ে রোজই সময় দিচ্ছেন অনেকে। তেমনই পয়লা বৈশাখকেও নিশ্চয়ই মনে রাখব আমরা। যদিও, অস্বীকার করবার কোনও প্রশ্নই নেই যে, মনখারাপ একটা হবেই হবে।

নতুন জামা’র বয়স বা বিলাসিতা, আমার অন্তত এখন কোনওটাই না থাকলেও, যেটা নেশার মতো আছে, সেটা হল দুপুর রোদ মাথায় চড়িয়ে বইপাড়ায় হানা দেওয়া। এ আমাদের শব্দশ্রমিকদের দীর্ঘ দিনের অভ্যেস, প্রকাশকদের ঘরে ঘরে যাওয়া, আড্ডা আর হইহুল্লোড় করা, খাওয়াদাওয়া আর কুশল বিনিময়ে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটা কাটানো। এ রীতি তো আজকের নয়। এই সুবাদে কত প্রবাদপ্রতিম লেখককে সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, আজও হয়। এ বার সেটা আর হবে না।

পয়লায় কত নতুন বই প্রকাশ পায়। সে সব কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধের সদ্যোজাত শরীর হাতে তুলে নেওয়ার যে অনাবিল আনন্দ আমরা প্রতি পয়লা বৈশাখে পাই, এ বার তা থেকেও বঞ্চিত থাকতে হবে।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

তবে হ্যাঁ, এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ জিনিস এই গ্রহ আগে দেখেনি। বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, ধর্মযুদ্ধ দেখেছে, মহামারী থেকে মন্বন্তর, সন্ত্রাসবাদ থেকে পরমাণু বোমা, সবই দেখেছে। কিন্তু কোনও একখানি ভাইরাসের প্রকোপে গোটা গ্রহের মানুষকে থমকে থাকতে হচ্ছে, ভেঙে পড়তে হচ্ছে তার অর্থনীতিকে, মৃত্যু মেনে নিতে হচ্ছে অগুনতি আক্রান্তকে, এ ইতিহাস পৃথিবীর খাতায় এর আগে লেখা হয়নি। তাই যেখানে সমস্ত অনুষ্ঠান উৎসব আয়োজন স্থগিত রাখা হয়েছে, সেখানে আমাদের বাঙালিদের এই পয়লা পার্বণও নিশ্চয়ই তোড়জোড় করে পালিত হবে না, সেই আশাই রাখব। আশা রাখব, মানুষজন দায়িত্বশীল নাগরিকের মতোই আচরণ বজায় রাখবেন, এই বিশেষ দিনটিতেও।

আর একটা কথা। আমরা যেন ভুলে না যাই যে, আমরা সেই শ্রেণির মানুষ, যারা এই অতিমারির ভয়াবহতার মধ্যে বসেও একটা লেখা লিখতে পারছি, একটা গান গাইতে পারছি, একখানা ছবি আঁকতে পারছি। অগুনতি মানুষ কিন্তু এমনও আছেন, যাঁরা সত্যিই জানেন না আগামিকাল কী খাবেন, কোথায় যাবেন। এমন বহু মানুষ আজও আমাদের দেশের পথে পথে হাঁটছেন, যাঁদের কোনও দিন বাড়ি পৌঁছনো হবে কি না, কেউ জানি না আমরা। এমন বহু মানুষ কিন্তু শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন, যাঁদের পরিবারের কেউ না কেউ মৃত্যু মেনে নিয়েছেন এই মারীতেই। তাই, নিজেদের সৌভাগ্যবান হওয়ার নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন নিশ্চয়ই আমরা করব না, এই আশাই রাখতে চাই। পয়লা আসবে তার মতো করে, চলেও যাবে। কিন্তু আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, যে দিন আমরা সকলে মিলে আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা সুস্থ আকাশের নীচে সমবেত প্রশ্বাস নিতে পারব, সেই দিনই এই পৃথিবীর পয়লা ঘোষিত হবে, নতুন করে। আমি সেই পার্বণের অপেক্ষায় থাকলাম তাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali New Year Covid-19 Srijato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE