Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

ছিল এবং আছের ফাঁকেই আটকে উন্নয়ন

বীরসিংহ হল আসলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাবার মামার বাড়ি। তাঁর পিতৃপুরুষের আদি ভিটে হুগলির বনমালীপুরে। বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষদের সেই গ্রাম কেমন আছে? ঘুরে দেখলেন অভিজিৎ চক্রবর্তী

বনমালীপুরের বিদ্যাসাগরের মূর্তির সামনে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা। ছবি: কৌশিক সাঁতরা

বনমালীপুরের বিদ্যাসাগরের মূর্তির সামনে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা। ছবি: কৌশিক সাঁতরা

অভিজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

চাষবাসই বনমালীপুর গ্রামের বাসিন্দাদের মূল জীবিকা। অন্যের জমিতে ভাগ চাষ কিংবা খেতমজুরির উপর নির্ভরশীল বহু বাসিন্দা। গ্রামের সেচ-বিদ্যুতের সুবিধা থাকলেও চাষ থেকে তেমন আয় হয় না। জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণও কম। এতেই মার খাচ্ছে গ্রামের আর্থিক পরিকাঠামো। তবে কিছুজন চাকরি করেন। জনাদশেক বাসিন্দা শিক্ষক, সরকারি কর্মী, পুলিশ-সহ নানা পেশায় যুক্ত। মলয়পুর হাসপাতাল থেকে বনমালীপুর গ্রামে ঢোকার মূল রাস্তাটি মোরামের। মোরাম ঠিকঠাক আছে। রাস্তা ১৫ ফুট মতো চওড়া। তবে সব জায়গায় সমান চওড়া নয়। রাস্তার দু’পাশে বসত গড়ে উঠেছে। ফলে রাস্তা হয়েছে অপরিসর। গ্রামের ভিতরের অন্য অধিকাংশ রাস্তা মাটির অথবা মোরামের। দু’চারটি রাস্তা ঢালাই হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় গ্রামে বিদ্যুৎ আসে। কেন্দ্রীয় লোকদীপ প্রকল্পে আলো জ্বলেছিল বিদ্যাসাগরের পিতৃপুরুষের গ্রামে। গ্রামের তফসিলি পরিবারের অনেকের মাসিক পাঁচ টাকা খরচে বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছিল। গ্রামটি এখনও আর্থিক দিক দিয়ে ততটা স্বাবলম্বী হতে পারেনি।

বীরসিংহের মতো বনমালীপুরকেও ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি স্থানীয় প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিরা। এমনই ক্ষোভ বনমালীপুরের। বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষদের বাসভূমির কথা গ্রামেরই অনেকের জানা নেই। কিছু উদ্যোগ অবশ্য মাঝে মাঝে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে পৈতৃক ভিটেয় বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি তৈরির উদ্যোগ করা হয়েছিল। হুগলি জেলা পরিষদ ও আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে গ্রামে বড় অনুষ্ঠানও হয়েছিল। এতে বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতিরও অবদান ছিল। সরকারি উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটেয় একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি বসানো হয়। সরকারি খরচেই মূর্তি বসানো হয়েছিল। পিতৃপুরুষের বংশের বর্তমান বংশধর অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে মূর্তিটি বসানো হয়। সেই সময়ই মলয়পুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ মূর্তির উপরে ছাউনি তৈরি করে দিয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন এবং বাসিন্দারা পর পর দু’তিন বছর বিদ্যাসাগরকে ভাল ভাবে স্মরণ করেছিলেন। গ্রামের মাঠে বিদ্যাসাগর বিষয়ক সেমিনারও হয়েছিল। উপস্থিত হয়েছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

নব্বইয়ের দশকে বীরসিংহের মতো বনমালীপুর গ্রামেও নিরক্ষতা দূরীকরণ অভিযানে একাধিক নৈশ বিদ্যালয় হয়েছিল। তার পর গ্রামটি পূর্ণ সাক্ষর ঘোষণাও হয়েছিল। শিক্ষার পরিকাঠামো থাকায় শিক্ষার হারে পিছিয়ে না থাকলেও বাকি সব কিছুতেই আর পাঁচটা গ্রামের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। এই সময়ে বনমালীপুর গ্রামটি নিয়ে চর্চা বাড়তে শুরু করে। তার আগে বনমালীপুর-সহ পাশাপাশি গ্রামের একাংশের কাছে গ্রামটি কেন বাংলার ইতিহাসে বিশেষ স্থান পাওয়ার যোগ্য তা অজানা ছিল! কিন্তু বনমালীপুর নিয়ে মাতামাতি বছর তিনেকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তেমন আর নজর দেওয়া হয়নি। বীরসিংহ গ্রাম যেমন দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল, বলমালীপুরের অবস্থাও একই। গ্রামে বিদ্যাসাগরের নামে একটি ক্লাব আছে। এইটুকুই! উত্তর বনমালীপুর প্রাথমিক স্কুলের দুয়ারে পাথরের ফলকে বিদ্যাসাগর পাঠাগার লেখা রয়েছে। তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রীমন্ত মালিক বলছিলেন, “সরকারি নথিতে স্কুলের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের নামের যোগ পাওয়া যায়নি।”

স্থানীয় প্রশাসনের তেমন আগ্রহ না থাকলেও বনমালীপুর গ্রাম নিয়ে বাইরের মানুষজন আগ্রহী। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে গবেষক, ছাত্র বনমালীপুর গ্রামে এসে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন। অনেকেই বিদ্যাসাগরের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করতে করেছেন। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর নিয়ে কাজ করছেন। তিনি যোগাযোগ করেছেন বিদ্যাসাগর পরিবারের সদস্য অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নিরঞ্জন বলছিলেন, “বনমালীপুরেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নানা সৃষ্টি রয়েছে। যার অনেক কিছুর অবশ্য প্রামাণ্য দলিল নেই। তবে বর্তমান বংশধরদের কাছ থেকে অনেক তথ্য জানতে পেরেছি।”

শুধু বনমালীপুর নয়, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে হুগলির জাহানাবাদ তথা এখনকার আরামবাগ মহকুমার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল। বনমালীপুরের খানিক দূরে খানাকুলের পাতুল গ্রামে বিদ্যাসাগরের মা ভগবতীদেবীর মামা বাড়ি। বাপের বাড়ি গোঘাটে। পাতুল গ্রাম ছিল বিদ্যাসাগরের প্রিয়। মায়ের মামা বাড়িতে ছোটবেলায় অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন।

সম্প্রতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দু’শো বছর পূর্তি উৎসব চলছে। বীরসিংহে গ্রামের মূল অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে অবহেলিত থেকে গিয়েছে বনমালীপুর। স্থানীয় প্রশাসনের তরফেও ওই বাড়িতে গিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়নি। বংশধরদের বাড়িতে দু’শো বছর অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোনও আমন্ত্রণপত্রও পৌঁছয়নি। বছর তিন-চারেক আগে বীরসিংহের সঙ্গে বনমালীপুরের মধ্যে সংযোগ তৈরির একটা চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টাও ততটা ফলপ্রসু হয়নি। বাসে চড়ে বীরসিংহ থেকে বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা কমিটির কয়েকজন সদস্য বনমালীপুরে গিয়েছিলেন। সঙ্গে বীরসিংহ গ্রামের বাসিন্দারাও ছিলেন। বনমালীপুরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরাও বীরসিংহে এসে ঘুরে যান। এই পর্যন্তই! দুই গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ দুই তরফেই বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের কেয়ারটেকার দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “এতদিন তো যোগাযোগই ছিল না। যখন শুরু হয়েছে, আবারও যোগাযোগ হবে। কমিটিরও তেমটাই পরিকল্পনা।” বনমালীপুর গ্রামের অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই কথা বলছেন।

এখন বনমালীপুর গ্রামে ২৬ সেপ্টেম্বর জন্মদিনে বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের বর্তমান সদস্যরা ছোট অনুষ্ঠান করে দিনটি পালন করেন। বংশের কনিষ্ঠতম সদস্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের গলায় মালা পরিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন।

বনমালীপুর গ্রামের বাসিন্দা তথা বিদ্যাসাগর ক্লাবের সদস্য প্রলয় মোদক, কার্তিক পণ্ডিতরা বলছিলেন, “ফের সরকারি ভাবে জন্মদিন পালন শুরু করা হোক। প্রাথমিক স্কুল ক্যাম্পাসে বিদ্যাসাগরের নামে মুক্তমঞ্চ তৈরির উদ্যোগ নিলে ভাল হয়। গ্রামটির সার্বিক পরিকাঠামো বাড়ানোর দিকে আরও নজর দিলে সমৃদ্ধি বাড়বে।” আরামবাগের প্রাক্তন বিধায়ক বিনয় দত্ত এবং প্রাক্তন মন্ত্রী নিমাই মালও বলছিলেন, “বনমালীপুর নিয়ে আরও কিছু করার ভাবনা ছিল। কিন্তু সবটা করা সম্ভব হয়নি।” মলয়পুর পঞ্চায়েতের সদস্য শাহ মহম্মদ রফিক বলেন, “গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন এবং মডেল গ্রামের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।” আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গুণধর খাঁড়া বলেন, “গ্রামের মানুষ এবং বিদ্যাসাগরের পরিবারের বর্তমান সদস্যদের সঙ্গেও এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।”

বনমালীপুরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুই বধূ জয়শ্রী ও রাজলক্ষ্মী বলছিলেন, “বিদ্যাসাগরের পরিবারের সদস্য এই পরিচয় নিয়েই বেঁচে আছি। এটাই আমাদের অহঙ্কার!” গ্রামে কান পাতলে একটা অসহায়তার কথা শোনা যায়। বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটে বনমালীপুরে। কিন্তু তা নিয়ে গর্ব করার মতো সময় বাসিন্দাদের অনেকেরই নেই। কারণ অন্ন চিন্তা যে চমৎকারা!

পেটের দায় মনীষীর দিকে মুখ ফেরাতে সময় পর্যন্ত দেয় না।

অন্য বিষয়গুলি:

Ishwar Chandra Vidyasagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy