স্থিতাবস্থাবিরোধী: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চূড়ান্ত রাউন্ডে মুখোমুখি ভিন্ন মেরুর দুই নেতা, এমানুয়েল মাকরঁ এবং মারিন ল্য পেন। রয়টার্স
এবার ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি-নির্বাচনের প্রথম পর্বেই যেন ভূমিকম্প। পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের প্রধান দুই যুযুধান দল রক্ষণশীল ও সমাজতান্ত্রিকরা পরাস্ত হয়েছেন। প্রথম স্থানে (২৪,০১% ভোট) উঠে এসেছেন ৩৯ বছরের যুবক এমানুয়েল মাকরঁ, রাজনীতির আঙিনায় যিনি অর্বাচীন। নব্য দল ও আন্দোলন অঁ মার্শ (এগিয়ে চল)-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি, যার অভিমুখ পরম্পরাগত রাজনৈতিক দলের থেকে কিছুটা আলাদা। তিনি ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিতে চান। দ্বিতীয় স্থানে (২১,৩০%ভোট) উঠে এসেছেন অতি দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন, তিনিও ফ্রান্সের দ্বিদলীয় মৌরসি-পাট্টার অবসান চান, তার সঙ্গে চান ইউরোপের প্রতি ফ্রান্সের মনোভঙ্গির পরিবর্তন। অর্থাৎ দুই জনেই ‘পরিবর্তনপন্থী’। বিশেষজ্ঞরা ২৩ এপ্রিল ২০১৭-র সঙ্গে মিল পাচ্ছেন ২০০২-এর ২১ এপ্রিলের। মারিন ল্য পেনের বাবা উগ্র জাতীয়তাবাদী দলের নেতা ও প্রথম সভাপতি জঁ মারি ল্য পেন সে বারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক হেভিওয়েট প্রার্থী লিওনেল জোস্প্যাঁকে পরাস্ত করে দ্বিতীয় পর্বে উঠে এসেছিলেন। সে বার, প্রথম পর্বে, গতানুগতিক দলের এক প্রতিনিধি বিদায় নিয়েছিলেন। এ বার গতানুগতিক রাজনীতির দুই নেতাই বিদায় নিলেন।
সুতরাং তরুণ মুখ ও নতুন দলের উত্থানই এ বারের ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। এ ক্ষেত্রে এমানুয়েল মাকরঁ-র অঁ মার্শ দলের সঙ্গে একই সারিতে ফেলতে হবে অতি-বাম জঁ লুক মেলঁশোঁর আন্দোলনকে। মেলঁশোঁর কর্মসূচি অবশ্য আরও বৈপ্লবিক। তিনি ফ্রান্সে রাষ্ট্রপতি-তন্ত্রের (যেটা প্রায় রাজতন্ত্রের সমার্থক হয়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করেন) অবসান চান। তাঁর মতে, পঞ্চম প্রজাতন্ত্র ঘুঘুর বাসা ও কায়েমি স্বার্থের আগার হয়ে উঠেছে। সুতরাং একে উচ্ছেদ করে যথার্থ জনতার রাজ কায়েম করতে হবে নতুন সংবিধানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি হয়ে তিনি প্রথমেই চাইবেন রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসান। নির্বাচনের প্রথম পর্বে ১৯.৫৮% ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থান পেয়েছেন মেলঁশোঁ। বলতেই হবে, এই বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সমর্থনে ভালই সাড়া পেয়েছেন তিনি। নতুন দল হিসেবে এ এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
নতুন রাজনীতির এই পুনরুজ্জীবন কি দরকার ছিল ফ্রান্সের মতো দেশে যেখানে জনগণের গড় আয়ু ক্রমবর্ধমান, বার্ধক্য নিয়ে সরকারি ও বেসসরকারি এত হরেক আয়োজন? সেখানে ২০০৭ সালের নির্বাচনে মোট ভোটদানকারীর ৩০%-এর বয়স তিরিশের নীচে, আর ৬৫%-এর বয়স ৬০ থেকে ৬৯-এর মধ্যে। রাষ্ট্রপতি সমেত জন-প্রতিনিধিদের অবস্থাও তথৈবচ। প্রত্যেকেই প্রায় বরিষ্ঠ নাগরিক। তাই শাসন-ব্যবস্থার ধারক-বাহকরা প্রায়ই তরুণ প্রজন্মের চাহিদার প্রতি উদাসীন। তার প্রভাব এসে পড়ে সরকারি ব্যয়-নীতির ওপর, সেখানে যতটা অগ্রাধিকার পায় বর্তমান, ততটাই বঞ্চনার শিকার হয় ভবিষ্যৎ। বার্ধক্য ভাতায় সরকার যত মুক্তহস্ত, বেকার-ভাতায় ততই অনুদার। রাজনৈতিক সমাজ যেহেতু তরুণ প্রজন্মের প্রতি উদাসীন , তরুণরাও স্বভাবতই ক্রমশ রাজনীতি-বিমুখ। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিসরচ্যুত তরুণের হতাশা, আক্রোশ। তাই হঠাৎ হঠাৎ উগ্র বিদ্রোহী আন্দোলন বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মতো বিপজ্জনক বিপথগামিতা।
দ্বিতীয়ত, বিগত শতকের নয়ের দশক থেকে, বিশ্বায়ন ফ্রান্সের অর্থনীতিতে বিশেষ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। ২০১২ সালের একটা হিসেব বলছে ২০০৪ থেকে ২০১২, বিগত আট বছরে ফ্রান্সে সাড়ে-চার লক্ষ মানুষ চাকরি খুইয়েছে। গত মার্চেই বেকারি বেড়েছে এক লাফে ১.৩%। এর বড় কারণ, শ্রমের খরচ বাঁচাতে ফ্রান্সের চৌহদ্দি ছেড়ে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশের উদ্দেশ্যে উৎপাদন-শিল্পের নিষ্ক্রমণ। এহেন বি-শিল্পায়নের ফলে যে বেকারত্ব, তারও প্রধান বলি তরুণ প্রজন্ম। ২০১৬ সালে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ফ্রঁসোয়া ওলঁাদ-এর সরকার এই রক্তক্ষরণের নিদান-স্বরূপ যে শ্রম আইনটি নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন তাতে চাকরির নিরাপত্তার প্রশ্নটি শুধু উপেক্ষিত হল না, এমনকী আরও মন্দ হল। তরুণ প্রজন্মের হতাশার আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। অতএব নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি রাজনীতির দিকে ফেরাতে দরকার পড়ল নতুন মুখের, নতুন দলের।
অতি দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন-এর রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে যে চিন্তাধারার ওপর, তার রাজনৈতিক চালিকা-শক্তি নিহিত এক উগ্র জাতীয়তাবাদে, তার অর্থনৈতিক আদর্শের বুনিয়াদ বিশ্বায়নবিরোধী সংরক্ষণবাদ, ও তার সমাজ-সাংস্কৃতিক ভিত বর্ণবিদ্বেষ ও স্বাজাতিকতা। তাঁর কল্পনার ফ্রান্স চার পাশ থেকে সীমান্তের কাঁটাতারে ঘেরা এক দেশ, বাকি ইউরোপের থেকে বিচ্ছিন্ন। সে দেশে অর্থনীতি হবে ‘দেশাত্ববোধক’, অভিবাসন নীতি হবে বজ্রকঠিন, অগ্রাধিকার পাবেন সাদা চামড়ার ‘খাঁটি’ ফরাসিরা। বলা হচ্ছে, ল্য পেনকে ভোট দিয়েছেন প্রধানত নিম্ন-আয়ের ‘সাহেব’-রা, বিশ্বায়নের পরিত্যক্তরা, গ্রাম-মফস্সলে বসবাসকারি বিশুদ্ধ ক্ষয়িষ্ণু ফরাসিরা ও ব্যাপক সংখ্যক তরুণ, যাদের ধারণা, সাম্প্রতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী ১) ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ, প্রধানত উত্তর আফ্রিকা-আগত ইসলাম-ধর্মাবলম্বী অভিবাসীরা, ২) ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তার মুদ্রা ইউরো। ২০০২-এর প্রথম পর্বের নির্বাচনে এই দলের জয়ে দেশের মাথায় যেমন বাজ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, এ বার কিন্তু তা হয়নি। তার মানে ‘নব্য-ফ্যাসিবাদী’ ফ্রোঁ নাসিওনাল (জাতীয় ফ্রন্ট)-এর এই গ্রহণযোগ্যতা মারিন ল্য পেনের সব থেকে বড় জয়।
এমানুয়েল মাকরঁ কিন্তু মনে করেন না, ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মূলে বিশ্বায়ন। তাই যদি হবে, তা হলে জার্মানির অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে কী করে? বরং এর জন্য দায়ী দেশের পরম্পরাগত দক্ষিণ ও বাম দলগুলির ভুল নীতি। বস্তুত, ট্রাম্পের আমেরিকা থেকে টেরেসা মে-র ব্রিটেন, পশ্চিম দুনিয়া জুড়ে নতুন করে সংরক্ষণবাদের যে ঢেউ উঠেছে, তার সামনে দঁড়িয়ে মাকরঁ-র প্রতি ফরাসিদের সমর্থন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে বিরাট শুভ লক্ষণ। এ ছাড়া ফ্রান্সের অভ্যন্তরে যে এক আমূল পরিবর্তনের ঝোঁক দেখা দিয়েছে সেখানে দাঁড়িয়েও মাকরঁ-র প্রতি সমর্থন একটি ইতিবাচক দিক। তিনি পরিবর্তনের কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে উগ্রতার ঝাঁঝ নেই। বরং তা বাস্তবাশ্রিত ও সংযত। তাঁর মূল ধারণাগুলো বাম ও দক্ষিণ দুই চিন্তাধারার থেকেই ধার নেওয়া। প্রথম পর্বের নির্বাচনেও তিনি একই সঙ্গে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী, দুই সমর্থনই পেয়েছেন। তাঁর বেকারত্ব নিরসনের বা মধ্যবিত্তের জন্য কর বা শুল্ক-ছাড়ের আয়োজনের মধ্যে যেমন বাম ঝোঁক, তেমনি সরকারি কর্মী-সংখ্যা বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি বাজেট ছাঁটের পরিকল্পনার মধ্যে দক্ষিণ-পন্থার ছায়া। প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্তা মধ্যপন্থী নতুন নেতার মতে, দেশকে এগিয়ে যেতে হলে এই ডান-বাম বিভাজনের উপরে উঠতে হবে। সদ্য রাজনীতিতে এসেই ফরাসি রাজনীতির এক পুরনো কৌশল তিনি সহজেই আত্মগত করে ফেলেছেন: ধারাবাহিকতাকে ক্ষুণ্ণ করে নয়, পরিবর্তন আনতে হয় ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখেই। সেখানে পরিবর্তনের সুফলটা থাকে, ঝুঁকিটা নিতে হয় না।
মূল পর্বের নির্বাচন ৭ তারিখ। ভোট বিশেষজ্ঞ সংস্থা ও প্রচার মাধ্যম মাকরঁ-কে মারিন ল্য পেনের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে রেখেছে: ৬১% বনাম ৩৯%। তবে একটা কথা বলাই যায়, অন্তিম পর্বের ফল যা-ই হোক না কেন, ‘পরিবর্তন’ কিন্তু এসে গেছে প্রথম পর্বেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy