ছবি: এএফপি।
কাশ্মীর উপত্যকায় সত্যই ইতিহাস রচিত হইল কি না, অনুমান করা চলে যে তাহাই উপত্যকার সাধারণ মানুষের নিকট সর্বাগ্রগণ্য প্রশ্ন নহে। বরং, দূরের গ্রামে থাকা পরিজনের খোঁজখবর পাওয়া, সন্তানের বিদ্যালয় চালু থাকা, বাজার করিতে পারা বা ভিন্রাজ্য হইতে প্রেরিত পার্সেল হাতে পাওয়া তাঁহাদের প্রাত্যহিকতায় জরুরিতর প্রশ্ন। কাশ্মীরের মানুষ ভাগ্যকে এক রকম মানিয়াই লইয়াছেন— তাঁহারা জানেন, জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা তাঁহাদের জন্য নহে। গত কয়েক দিনে এই ভূতপূর্ব রাজ্যটিকে কেন্দ্র করিয়া যে ভূ-রাজনৈতিক খেলা চলিল, তাহাতে উপত্যকার ‘অস্বাভাবিক’ জীবনযাত্রাও ব্যাহত। কার্ফু চলিতেছে, টেলিফোন-মোবাইলের সংযোগ নাই, কেব্ল টেলিভিশন বন্ধ। ডাক যোগাযোগও বন্ধ। লক্ষণীয়, কাশ্মীরের ঘটনাক্রম লইয়া গোটা দেশের প্রতিক্রিয়া শোনা যাইতেছে, একমাত্র ব্যতিক্রম কাশ্মীর। কারণ, উপত্যকা হইতে কোনও কণ্ঠস্বরের বহির্বিশ্বে পৌঁছাইবার সব পথ বন্ধ। রাজনীতির সমীকরণ সরাইয়া রাখিলে বোঝা যায়, এই অবস্থায় মানুষের পক্ষে বাঁচিয়া থাকা অসম্ভব। এমনকি কাশ্মীরিদের পক্ষেও, যাঁহারা আফস্পা-র বাস্তবেই বাঁচেন।
রাজনীতি তাহার পথে চলিবে। কিন্তু, উপত্যকার সাধারণ মানুষকে ‘স্বাভাবিক’ জীবনের অধিকার যত দ্রুত সম্ভব ফিরাইয়া দিতে হইবে। বস্তুত, এই কথাটি যে আলাদা ভাবে উল্লেখ করিতে হইতেছে, তাহা তাৎপর্যপূর্ণ। কাশ্মীরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অধিকার যত সহজে, যত বার, যত দিনের জন্য ব্যাহত হয়, গোটা দেশের অন্য কোনও প্রান্তে তাহার তুলনা খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। সেই বিঘ্নিত অবস্থাই যেন উপত্যকায় স্বাভাবিক। যাঁহারা ‘এক দেশ, এক ব্যবস্থা’র প্রতিষ্ঠা দেখিয়া আকুল হইতেছেন, দায়িত্ব তাঁহাদেরও— জীবনযাত্রার অধিকারের প্রশ্নে সমগ্র ভারতের সহিত কাশ্মীরের মানুষের যেন ফারাক না থাকে, রাষ্ট্রের নিকট সেই দাবি পেশ করা বিধেয়। অতিজাতীয়তাবাদের রাজনীতি কাশ্মীরের মাটি লইয়া যতখানি ভাবিত, মানুষ লইয়া তাহার কণামাত্র নহে। তাহার কারণ কী, সেই প্রশ্ন আপাতত বকেয়া থাকুক। কিন্তু, এই পার্থক্যটি মুছিতে হইবে। কোনও স্বাধীন দেশের নাগরিকদের একাংশের সহিত এই আচরণ যে করা চলে না, তাহা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানানো বিধেয়। কাশ্মীর যদি সত্যই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়, তবে কাশ্মীরের মানুষেরও স্বাধীন ভারতবাসীর পূর্ণ মর্যাদা পাওয়া প্রয়োজন। নচেৎ, উপনিবেশবাদের গন্ধটি প্রকট হইয়া উঠে।
৩৭০ ধারা বিলুপ্তির সিদ্ধান্তটি কাশ্মীরের মানুষের নিকট বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে প্রতিভাত হইতে পারে। তাহাতে ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতি কাশ্মীরিদের আনুগত্য বাড়িবে বলিয়া আশা করা কঠিন। রবিবারের সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীর যদি ‘প্রকৃতার্থেই ভারতের অন্তর্ভুক্ত’ হইয়াও উঠে, সাধারণ মানুষের আনুগত্য ভিন্ন নয়াদিল্লি সেই ভূখণ্ডকে শাসন করিবে কিসের জোরে? শুধুই বন্দুক-বেয়নেটে? যথার্থ গণতন্ত্রে তাহার অবকাশ নাই। ফলে, হয় কাশ্মীরকে ‘বিচ্ছিন্ন, গণতন্ত্রহীন’ ভূখণ্ড হিসাবেই মানিয়া লইতে হইবে (যদি তাহাই মানিতে হয়, তবে আর এত কাণ্ডের প্রয়োজন কী ছিল, তাহা বোঝা দুষ্কর), নচেৎ উপত্যকার মানুষকে ভারতের প্রতি অনুগত করিয়া তুলিতে হইবে। তাহার জন্য উপত্যকার জনজীবনকে প্রকৃত অর্থে স্বাভাবিক করিয়া তোলা প্রয়োজন। উপত্যকার মানুষকে বোঝানো প্রয়োজন যে দেশের অন্য নাগরিকদের যে অধিকার আছে, তাঁহাদের অধিকারও ততখানিই। শুধুমাত্র মানবিকতার তাগিদেই এই কাজটি করা উচিত। কিন্তু, মানবিকতার যুক্তিতে যদি কঠোর জাতীয়তাবাদের চিঁড়া না ভেজে, তবে ইহাকে আনুগত্য অর্জনের পন্থা হিসাবেও দেখা যাইতে পারে। গণতন্ত্রে এই স্বেচ্ছা-আনুগত্যের কোনও বিকল্প নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy