বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার মান ও খরচ নিয়ন্ত্রণ করুক সরকার, এই দাবিতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে কয়েকটি সর্বভারতীয় চিকিৎসক সংগঠন। এই দাবি কতটা সঙ্গত, তা বিতর্কের বিষয়। এক পক্ষের যুক্তি, স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয় বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিয়ম মেনেই হওয়া উচিত, তাতে উৎকর্ষ নিশ্চিত হয়, খরচও ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা অনুসারে নির্ধারিত হয়। জোর করে খরচ কমাতে গেলে মানের অবনতি হবে, রোগীর নির্বাচন-ক্ষমতা কমবে। বেসরকারি চিকিৎসা কিনতে যাঁরা অপারগ বা অনিচ্ছুক, তাঁদের জন্য সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। অপর পক্ষের যুক্তি, চিকিৎসা আর পাঁচটি ক্রয়যোগ্য পরিষেবার মতো নয়। এটি এক অত্যাবশ্যক পরিষেবা। উপরন্তু, চিকিৎসার দাতা ও গ্রহীতা, অর্থাৎ হাসপাতাল ও রোগী, দু’পক্ষের মধ্যে জ্ঞানের দূরত্ব— এই ডিজিটাল যুগেও— অনতিক্রম্য। অতএব রোগীর স্বার্থের সুরক্ষা দরকার, এবং তা করতে হবে সরকারকেই। গত ফেব্রুয়ারিতে একটি জনস্বার্থ মামলা এই বিতর্ককে পেশ করেছে সুপ্রিম কোর্টের সামনে। মামলাকারী প্রশ্ন তুলেছেন, ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্টস অ্যাক্ট, ২০১০ অনুসারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার মান, চিকিৎসকের পারিশ্রমিক এবং চিকিৎসার খরচ নিয়ন্ত্রণ করার কথা সরকারের। অথচ, একই চিকিৎসার খরচ নানা প্রতিষ্ঠানে নানা রকম, এবং প্রায়ই তা রোগীর সাধ্যকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। এতে কি আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে না?
এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালত কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে, রাজ্যগুলির সঙ্গে পরামর্শ করে বিভিন্ন চিকিৎসার যথোপযুক্ত খরচ নির্দিষ্ট করতে। কেন্দ্র একটি হলফনামা পেশ করে এই দায়িত্ব রাজ্যগুলির উপরেই ন্যস্ত করতে চেয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলির একটি সংগঠন, এবং চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর তরফ থেকে সব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার একই খরচ বেঁধে দেওয়ার বিরোধিতা করে আবেদন করা হয় আদালতে। তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে ‘জনস্বাস্থ্য অভিযান’ এবং ‘ফোরাম ফর একুইটি অ্যান্ড হেলথ’ নামে চিকিৎসকদের দু’টি সংগঠন। এই চিকিৎসকদের দাবি, অত্যধিক এবং অনাবশ্যক খরচের জন্য রোগীদের সর্বস্বান্ত হতে দেখছেন তাঁরা। একই চিকিৎসার জন্য কেন নানা প্রতিষ্ঠানে খরচে এত হেরফের হবে (যেমন, সিজ়ারিয়ান সেকশন করার খরচ ত্রিশ হাজার টাকা থেকে দেড় লক্ষ টাকা) সে প্রশ্নও তুলছেন এই চিকিৎসকেরা। তাঁদের অভিযোগ, বারোটি রাজ্যে ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্টস অ্যাক্ট পাশ হয়ে থাকলেও, বেসরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের কোনও চেষ্টা করেনি সরকার।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, সরকার বা আদালত চিকিৎসার খরচ নির্ধারণ করে দিলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোতে বিনিয়োগের উৎসাহে যদি ভাটা পড়ে, দীর্ঘমেয়াদে তাতে রোগীরই ক্ষতি। অথচ এ-ও সত্য যে, গড়পড়তা অসুখের চিকিৎসাও অত্যধিক ব্যয়সাপেক্ষ করে তুলছে বহু বেসরকারি হাসপাতাল। খরচ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি জনসমক্ষে ‘বাজার বনাম সরকার’ আকারে আসে বটে, কিন্তু সমস্যা আসলে এই যে, যে-কোনও জনপরিষেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি সরবরাহকারীদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা এড়াতে চায় সরকার। সরকারি স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্র বা রাজ্য। তদ্ব্যতীত কোনও ভাবে বেসরকারি হাসপাতালের কার্যপ্রণালী বা খরচের মূল্যায়ন বা নিয়ন্ত্রণ করে না। পশ্চিমবঙ্গেও ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন’ প্রধানত অভিযোগ নিষ্পত্তির কাজটিই করছে। বৃহৎ বাণিজ্যের কাছে ‘অপ্রিয়’ হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজনৈতিক অনীহার জন্য নাগরিকের ক্ষতি হচ্ছে, চিকিৎসা ক্ষেত্রটিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। সর্বস্তরের মানুষ সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন কি না, সে প্রশ্নটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy