দৃশ্য এক। খবরের চ্যানেলে তুমুল তর্ক চলছে। কাশ্মীর নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নানা যুক্তি দিচ্ছেন এক বক্তা। কিছুতেই পেরে না উঠে প্যানেলে থাকা বিজেপির মুখপাত্র গলার শিরা ফুলিয়ে বলে উঠলেন, “আপনাকে চিনি না, কিন্তু আপনি পাক্কা পাকিস্তানিদের সুরে কথা বলছেন।” স্তম্ভিত বক্তার নাম কপিল কাক। ভারতের প্রাক্তন এয়ার ভাইস মার্শাল। বিমানবাহিনীতে ৩৪ বছর কাজ করেছেন। রাষ্ট্রপতির থেকে পেয়েছেন ‘বিশিষ্ট সেবা পদক’। এবং তিনি কাশ্মীরি পণ্ডিত।
দৃশ্য দুই। রাতের সুনসান লালচক। ১৪৪ ধারা জারি থাকা কাশ্মীর। মাঝরাস্তায় দাঁড় করানো গাড়ি থেকে তারস্বরে ভেসে আসছে মিকা সিংহের গান ‘জাট্টা দা ছোরা’। ভাংড়ার তালে মত্ত জনা ছয়েক হরিয়ানার যুবক। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সেনা গাড়ি।
সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে এমন ঘুরপথে দুর্বল করে দেওয়া অসাংবিধানিক? অনৈতিক? কাশ্মীরের মানুষেরই স্বরকে অগ্রাহ্য করা এই সিদ্ধান্ত অন্যায়? প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হয়তো বিশ্বের সব থেকে বড় গণতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে, আপনার-আমার মতো গুটিকয়েক মানুষের মাথা হেঁট করে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ‘সেকু-মাকু-লিবটার্ড’দের এই উদ্বেগে কিচ্ছু যায় আসে না এই নয়া ভারতের অন্দরে-অন্তরে ‘প্রাউড হিন্দু’ ন্যাশনালিজ়মের। এক দেশ, এক ছাতা। দেশের এই গর্বিত সন্তানেরাই আজ সংখ্যাগুরু। আন্তর্জালে আর বাস্তবের মাটি, দু’জায়গাতেই গণপ্রহারে ব্যস্ত তাঁরা। অবরুদ্ধ কাশ্মীরিদের এই দুর্দশা তাঁরা ‘সেলিব্রেট’ করছেন। তাঁরা একটা ভূখণ্ডের দখল চান। এখানেই জিতে যাচ্ছেন অমিত শাহেরা।
হারছেনও। তুখড় চাণক্যের মতো ভোটের বাক্সে যত জয় সুনিশ্চিত করছেন, তত হারছেন নৈতিকতার মাপকাঠিতে। বিপর্যস্ত করছেন ভারত নামক এক সুমহান ধারণাকেই। ৩৭০ ধারার পরিবর্তনে, সংখ্যার জোরে আর সৈন্য দিয়ে মুড়ে এক দিন হয়তো মোদী-শাহ ‘ভূস্বর্গ’কে সত্যই ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য’ অংশে পরিণত করবেন। কিন্তু আরও দূরে ঠেলে ফেলে দেবেন ‘কাশ্মীর’ নামক আইডিয়াকে। যার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ‘কাশ্মীরিয়ত’। এক দিন ভারতের উপরে ভরসা করেছিল কাশ্মীর, পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে জুড়েছিল সেই ভারতের সঙ্গেই। সেই কাশ্মীরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল ভারত। যে ভারত মানত, কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তানের সম্পত্তি নয়। কাশ্মীর তার জনগণের। মুসলিম-সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীর তার সংবিধানে প্রাণ করেছিল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকেই। পুরনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে কাশ্মীরকে কোন বার্তা দিল সরকার? হাতে হাত রেখে নয়, এই নয়া ভারত রাষ্ট্র কাশ্মীরিদের ঘরে ঢুকবে শোষণযন্ত্রের কাঁধে চড়ে। যেটুকু গণতন্ত্র বাকি ছিল, সেটুকুও কলমের এক আঁচড়ে মুছে দেবে। কাশ্মীর তার চাই, কাশ্মীরিদের নয়। কাশ্মীরিদের মন পরিবর্তনে নয়, বিরুদ্ধতার সুরকে নীরব করা হবে গানপয়েন্টেই। তাঁদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে তাঁদের সম্মতি ছাড়াই। এই নয়া ভারত জানেই না, এত দিন অন্তত যা ঢাকা ছিল ‘গণতন্ত্র’-এর চাদরে, দখলের সেই গল্পটাকে সে নিজেই আজ ছাতি ফুলিয়ে প্রকাশ্যে আনল সারা দুনিয়ার সামনে। এই ভারতের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরির ভরসা জয় সম্ভব নয়। আশঙ্কা, এই ভারত কোনও দিন ভরসা জিতবে না কাশ্মীরি পণ্ডিতদেরও। তাঁরা ভিটে হারিয়েছেন, ‘কাশ্মীরিয়ত’ হারাননি।
দুই ভারতের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এক ভারতে দাঁড়িয়ে আর্যঋষি শোনাচ্ছেন, অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।/ ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি॥ (অধর্মের দ্বারা আপাতত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, কুশল লাভ হয়, শত্রুদেরও জয় করা যায়, কিন্তু সমূলে বিনষ্ট হতেই হয়।) এই বাণী স্মরণ করিয়ে ওই ভারতের হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “এই ধর্মবাণী সকল দেশের সকল কালের চিরন্তন সত্য, ন্যাশনালত্বের মূলমন্ত্র ইহার নিকট ক্ষুদ্র ও ক্ষণিক। নেশন শব্দের অর্থ যখন লোকে ভুলিয়া যাইবে তখনো এ সত্য অম্লান রহিবে এবং ঋষি-উচ্চারিত এই বাক্য স্পর্ধামদমত্ত মানবসমাজের ঊর্ধ্বে বজ্রমন্ত্রে আপন অনুশাসন প্রচার করিতে থাকিবে।” আর নয়া ভারত? জিয়ো-র ‘ফ্রি’ ২জিবি ডেটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবড়ে দেয় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুকে। পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ-ছিন্ন কাশ্মীরি তরুণীর উদ্বেগ নিয়ে খিল্লি করে।
একদা এই দেশের জেলবন্দি এক তরুণ ইংরেজ সরকারকে চিঠি লিখেছিলেন, “আপনাদের হাতে ক্ষমতা আছে। এবং ক্ষমতার সামনে পৃথিবীতে আর কোনও রকমের সওয়াল জবাবের প্রয়োজন হয় না। আমরা তো জানি যে আপনারা ক্ষমতাই সত্য নীতিতে বিশ্বাস করেন।” বিশ্বাস করতে ভরসা হয়, আজ ভগৎ সিংহ বেঁচে থাকলে সবার আগে তিনিই কাশ্মীরিদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। আর বর্তমান সরকারের চোখে চোখ রেখেও এই একই কথা বলার সাহস রাখতেন।
আজ গোটা কাশ্মীরটাকেই জিপের বনেটে বেঁধে ঘোরাচ্ছে এই নয়া ভারত। হাততালি দিচ্ছে, ভিডিয়ো তুলে ভাইরাল করছে একদল জনতা। উল্লাসে ফেটে পড়ছে এই দুর্ভাগা রিপাবলিকের মিডিয়া। আমরা নীরব দর্শক।
ঠিক সেখানেই ভারতের পরাজয়।
ফলতা সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক
n ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy