প্রায় দেড় বছর ধরে বাড়ি ফেরা হয় না অভয়ের, আট মাসের বাচ্চা মেয়েটাকেও কোলে নিতে পারে না, মাথা-গরম হয়ে থাকে। কাশ্মীরে মোতায়েন সেন্ট্রাল রিজ়ার্ভ পুলিশ
ফোর্সের জওয়ান বলে অবিরত তাকে বন্দুক হাতে খুঁজে বেড়াতে হয় সন্ত্রাসীদের, না পেলে নাগালের মধ্যে কাশ্মীরি মানুষজনকে ধরেই...। একটি কমবয়সি ছেলে তাদেরকে ঢিল ছুড়েছিল বলে গুলি করেই তাকে উড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল। সহকর্মীর বাধায় পেরে ওঠেনি।
এ হেন অভয় হঠাৎ সাত-আট বছরের কাশ্মীরি বালক হামিদের হারিয়ে-যাওয়া বাবার ভূমিকা নেয়। হামিদের বাবা তাঁদেরই এক জন যাঁরা প্রতি দিন গায়েব হয়ে যাচ্ছেন। লোপাট হয়ে গিয়েছেন এমন কাশ্মীরির সংখ্যা এখন দশ হাজার, হয়তো তারও বেশি, নিশ্চিত জানি না। অভয় আর হামিদের এই অদ্ভুত সম্পর্ক নিয়ে এজাজ় খান যে ছবিটা করেছেন, সেই ‘হামিদ’ মাস পাঁচেক আগে মুক্তি পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠেও গিয়েছিল। নেহাত ক’দিন আগে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ায় আর কাশ্মীর নিয়ে তুমুল শোরগোল ওঠায়, ফের খেয়ালে এল ছবিটা।
পরিচালক খানসাহেব সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, দর্শককে তিনি ফিরিয়ে নিতে চেয়েছেন কাশ্মীরের ‘অ্যাকচুয়াল রিয়েলিটি’তে। তাই তাঁর ছবিতে ভারত সরকারের আধা-সামরিক বাহিনীর যে জওয়ানটিকে দেখি, সে অতি সাধারণ মানুষ, অযথা শহিদ হওয়ার বাসনা নেই তার। ঠিক এ কারণেই কিন্তু খানসাহেব ও তাঁর ছবিটি ব্রাত্য বলিউডে। আর কুলীন হলেন আদিত্য ধর আর তাঁর ছবি ‘উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’, জাতীয় পুরস্কারেও সেরা পরিচালকের মুকুটটি পরেন আদিত্য। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানকে ভারতীয় সেনার ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার ছবিটি জানুয়ারিতে মুক্তি পেয়ে সারা দুনিয়া জুড়ে এমন বাণিজ্য করেছে যে হলিউডও হার মেনেছে। স্বাভাবিক। পিতৃহীন হামিদের পিতা-প্রত্যাবর্তনের কাহিনি থেকে অনেক আকর্ষক পাকিস্তানকে পেঁদানোর কাহিনি। স্বাধীনতার শুরু থেকেই তো আমরা কি ক্রীড়াক্ষেত্রে, কি রণক্ষেত্রে, পাকিস্তানকে হারাতে পারলেই অসম্ভব খুশি। আদিত্য জানিয়েছেন, তাঁর ছবিটি এমন ভাবে তৈরি যাতে এটি দেখার পর প্রতি পরিবারের প্রতিটি তরুণের মনে হবে— এক্ষুনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া উচিত।
এই ‘উচিত’ কাজটিই বলিউডের কুলীন পরিচালকেরা করে চলেছেন গত আড়াই দশকের ওপর, তাঁদের সমস্ত ছবিতেই কমবেশি যখনই কাশ্মীরের সন্ত্রাসীরা হানা দিয়েছে নায়কের ব্যক্তিগত জীবনে, তখনই তারা তাদের আত্মস্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে শরণ নিয়েছে রাষ্ট্রব্যবস্থার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যতই ব্যক্তিগত উদ্যোগে লড়ুক তারা, অভিভাবকের মতো তাদের সঙ্গে থাকে কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা। ব্যক্তিকে গৌণ করে ফেলে রাষ্ট্রের এই সমষ্টিবোধেই আচ্ছন্ন হয়ে আছে কাশ্মীর নিয়ে মন-জিতে-নেওয়া বলিউডি ছবিগুলো। তেমন দু’-এক জন কুলীন পরিচালকের কীর্তির কথা না-বললেই নয়।
গত ও নতুন শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে বিধু বিনোদ চোপড়া তাঁর ‘মিশন কাশ্মীর’ ছবিতে এক ইনস্পেক্টর জেনারেল আমদানি করেছিলেন, যিনি বিবেকবান, যিনি মানেন যে সন্ত্রাস দমনে নিরীহ কাশ্মীরিরাও মারা পড়েন, কিন্তু আবার এও বিশ্বাস করেন, সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর উপর ভর করেই সন্ত্রাসীদের খপ্পর থেকে অসহিষ্ণু জেহাদি কাশ্মীরি তরুণদের বার করে আনতে হবে। রাষ্ট্রই যেন দেশমাতৃকার মুখচ্ছবি, ফলে সন্ত্রাসবাদের দাওয়াই হিসেবে রাষ্ট্রীয় পীড়ন মেনে নেওয়ার বাধ্যতা তৈরি হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় শাসনকে যে ভাবে গৌরবান্বিত করা হয় এ-ছবিতে, কাশ্মীরিদের স্বাধীন ভাবে কথা-বলা বা স্বাধিকারের প্রশ্নটি তাতে অনায়াসে চাপা পড়ে যায়।
এক ধরনের আধিপত্যকামী শাসনের আখ্যানেই ভরে উঠছিল কাশ্মীর-সংক্রান্ত ছবিগুলি, নব্বইয়ের দশক ও শতক-শুরুর দশকে। এলওসি কার্গিল, লক্ষ্য, ফানা, তাহান, সিকান্দার, ইয়াহান, লামহা... ছবিগুলিতে অবিরাম সন্ত্রাসী হানা, নিসর্গের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও সুন্দরী নারী সত্ত্বেও কী ভাবে ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, সন্ত্রাসীদের প্যাঁচপয়জার-ষড়যন্ত্র, পুলিশ বা সেনার দুঃসাহসিক বীরত্ব। বাব, শিন, আই অ্যাম... এই ছবিগুলিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উৎখাতের আখ্যান, কী নির্মম ভাবে তাঁদের খুন করেছিল সন্ত্রাসীরা। ঘুরেফিরে সেই একই কাহিনি, নিন্দিত সন্ত্রাসবাদ আর সেনাবাহিনীর জয়ধ্বনি। আর এই দুইয়ের মাঝখানে চিঁড়েচ্যাপ্টা কাশ্মীরিরা, যাঁদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর শোনাই যায় না কোনও ছবিতেই। সামান্য ব্যতিক্রম ওনিরের ছবি ‘আই অ্যাম’-এ ‘মেঘা’র অংশটুকু, যেখানে কাশ্মীরি পণ্ডিত মেঘা কাশ্মীরে ফিরে যায় তার মুসলিম বান্ধবী রুবিনার কাছে, বিপন্নতাই তাদের দু’জনকে পরস্পরের কাছে টেনে আনে। বছর পাঁচেকের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রমী ছবি ‘হায়দর’, তবে সেখানেও পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ কাশ্মীরি স্বর শোনানোর চেয়ে একটু যেন বেশি ব্যস্ত ছবির শেক্সপিয়রীয় শিল্পকাঠামো রক্ষায়, এমনকি ছবির শেষে কাশ্মীরের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সেনাবাহিনীর নায়কোচিত ভূমিকাও পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে ভোলেননি তিনি।
শুরুটা করেছিলেন কিন্তু মণি রত্নম, ‘রোজা’র পরিচালক। কাশ্মীরিদের বিপন্নতার কথা বেমালুম চেপে গিয়ে, পাকিস্তানি প্ররোচনায় কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদের কারণে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে কতখানি বিপন্ন, তিনিই প্রথম তা প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন ছবিতে। সন্ত্রাসবাদ থেকে দেশের জীবনযাত্রাকে মুক্ত করার তাগিদে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ‘গ্লোরিফাই’ করা হল ছবিটিতে, সে কথা তিনি নিজে বলেছেনও। ১৯৯২-এর ১৫ অগস্ট, স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি-পাওয়া এ-ছবিটি শুরু হওয়ার আগে পর্দায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের বয়ান ফুটে উঠত। জাতীয় সংহতির পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটি।
অথচ, এই সেনাবাহিনী, এই সন্ত্রাস, এই সব ছবিতে দেখা জীবনের বাইরে একটা আলাদা কাশ্মীরও আছে। তাতে আছে কাশ্মীরি সাধারণের নিজভূমে পরবাসী থাকার যন্ত্রণা, আছে তাঁদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন ও নির্যাতনের চিহ্ন, আছে তাঁদের নিখোঁজ-নিহত হওয়ার তথ্য। তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ক্রমাগত খর্ব করার জন্যে ভারত সরকারের পাঠানো পুতুল-রাজনীতিকরা আছেন; আবার তাতে পাক-পন্থী মৌলবাদীরাও আছে, আছে বিচ্ছিন্নতাকামী সন্ত্রাসবাদীরাও। এ এমন এক জটিল ইতিহাস যা আড়াই হাজার প্রবন্ধ লিখেও কুলিয়ে ওঠা যায় না। নিজেদের সব দায়িত্ব অস্বীকার করে দিল্লির শাসকগোষ্ঠী এখন যে ভাবে অশান্ত কাশ্মীরের যাবতীয় দায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর সন্ত্রাসবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেশে জাতীয়তাবাদী উগ্রতাকে
খুঁচিয়ে তুলছে, অন্যদের মতো মণিও সে দিন আড়াই ঘণ্টার ছবিতে ঠিক সে ভাবেই তাঁর কাহিনির কাঠামোটাকে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন— কী আশ্চর্য যোগাযোগ!
অথচ ‘হামিদ’-এর মতোই কাশ্মীরিদের বিপন্ন জীবন, দুঃসহ বেঁচে থাকা নিয়ে কিছু ছবি কিন্তু হয়েছে। হাতেগোনা হলেও হয়েছে। হারুদ, হাফ উইডো, নো ফাদার্স ইন কাশ্মীর— প্রথম ছবিটির পরিচালক আমির বশির জঙ্গি ও সেনাকর্মীদের লাগাতার সন্ত্রাসে অসহায় কাশ্মীরিদের প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, মানসিক ভাবে কতখানি বিপর্যস্ত তাঁরা, সম্ভ্রমরক্ষার্থে প্রতি দিন কী ভাবে লড়াই করতে হয় তাঁদের, কেননা বিশেষ ক্ষমতার বলে বলীয়ান সেনাবাহিনী যে কোনও সময়ে তাঁদের যে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। ক্ষুণ্ণ স্বরে বশির বলেছিলেন, ‘দিস ইজ় আ ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড ইউ কান্ট নেগেট দ্য রুল অব ল’। এ সব ছবি আমরা দেখতে যাইনি, দেখতে চাইনি। বরং বলিউডের বানানো বিনোদনেই বুঁদ হয়ে থাকতে চেয়েছি।
কেন এমন? ফের মণি রত্নমেই ফিরে যাই।
কিছু দিন আগেই বিশিষ্ট জনদের সঙ্গে মিলে তিনি দেশের আক্রান্ত নাগরিকদের বিপন্নতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন, তাতে অমোঘ দু’টি লাইন ছিল। একটি: ‘দেয়ার ইজ় নো ডেমোক্র্যাসি উইদাউট ডিসেন্ট’, অন্যটি: ‘নো সিটিজ়েন শুড হ্যাভ টু লিভ ইন ফিয়ার ইন হিজ়/ হার ওন কান্ট্রি’।
তাঁর ছবি আর চিঠি আমাদের মনে অনিবার্য প্রশ্ন তোলে: মণি কি কাশ্মীরিদের এ-দেশের নাগরিক বলেই গণ্য করেন না? আমরাও করি কি? কাশ্মীরিদের ‘ভারতীয়’ বলে আমরা কোনও
দিনই ভাবতে পারিনি। মানতেও পারিনি।
কংগ্রেসের ‘সহিষ্ণু’ জমানাতেও, বিজেপি’র ‘অসহিষ্ণু’ জমানাতেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy