এই সেই গুজরাত মডেল, মতান্তরে ‘বিকাশ মডেল’: টুইট-বার্তায় লিখলেন গুজরাতের দলিত নেতা জিগ্নেশ মেবানী। এই মহাপ্রতাপান্বিত মডেলে বিকাশ নামক মরীচিকালোকের আড়ালে জাত-ধর্ম-শ্রেণিহিংসার নিয়ত চলাচল। প্রাত্যহিক, স্বাভাবিক, সমাজস্বীকৃত বিভাজন, অপমান ও প্রহারের বাস্তব। চলতি সপ্তাহে রাজকোটে দলিত জঞ্জালকুড়ানি যুবক মুকেশ বানিয়াকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গণপ্রহারে মেরে ফেলা হল। আর তাঁর স্ত্রী জয়াবেন প্রবল লাঞ্ছিত হলেন। ভিডিয়ো দেখে শিউরে উঠল সারা দেশ। মডেলই বটে। এই ছবি দেখামাত্র দুই বছর আগের সেই মর্মান্তিক ছবি ত্বরিতে স্মৃতিতে ধাক্কা দিয়ে যায়। ২০১৬ সালের জুলাই: চার জন দলিত যুবককে গির জেলার উনা অঞ্চলে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে ভয়ানক মারে মৃতপ্রায় করে ফেলা হয়েছিল!
ছোটখাটো ডিটেলে তফাত। এ বারে মুকেশকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। সে বার ওদের বাঁধা হয়েছিল চেন দিয়ে। সে বার যে গাড়ির সঙ্গে বাঁধা হয়েছিল, তার গায়ে শিব সেনার স্টিকার ছিল। এ বার পিটুনিকারীদের গায়ে স্টিকার নেই! সে বার চার লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ছিল, এ বার আট লক্ষ। সে বার অনেক প্রতিবাদের মধ্যেও তেমন ভাল নেতা ছিলেন না। এ বার ঘটনা ঘটামাত্র মুখ্যমন্ত্রী রুপানির উদ্দেশে জিগ্নেশের মোক্ষম টুইট— প্রাণে মারার পর ক্ষতিপূরণ চাই না, তিন সপ্তাহের মধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট চাই! ক্ষতিপূরণের ফাঁক দিয়ে চার্জশিট কী ভাবে গলে উবে যায়, আর অভিযুক্তরা বেকসুর ঘুরে বেড়ায়, সকলেই জানে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা খাপে খাপে জুড়ে গেলে যেমনটা হয়। পিটুনিবাজির প্রবাহ চলে, অনিবার, কখনও চেন দিয়ে বেঁধে, কখনও দড়ি দিয়ে।
পিটুনিবাজিরও বহু রূপ। নিম্নবর্গের মানুষ ‘নিম্ন’ কাজ করলে লাঠি বা বেতের মার। নিম্নবর্গের মানুষ ‘উচ্চ’ কাজ করতে চাইলে ঘুরিয়েপেঁচিয়ে অপমানের মার। মুকেশের পর দিনই এল সন্দীপ গুপ্তের খবরটা। জামসেদপুরের সব্জি-বিক্রেতার ছেলে সন্দীপ পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন বলে অনেক দূর এগিয়েছিলেন, মুম্বইয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ (টিস) এমএ করছিলেন। পড়া শেষে সার্টিফিকেট পাওয়ার সময় স্টেজে উঠে আবিষ্কার করলেন, তাঁর হাতে সার্টিফিকেটের বদলে কার্ডবোর্ডে লেখা একটা নোটিস: ‘নট পেড ফি অব হোস্টেল, ডাইনিং হল, সিমেস্টার ফি’জ।’ টাকা বাকির নোটিসটা বড় কথা নয়, বড় কথা কায়দাটা। ঠিক কী ভাবে দিলে অসম্মানটা তীক্ষ্ণ খোঁচায় বিঁধবে, ভেবেচিন্তেই কার্ডবোর্ডটির আইডিয়া! এবং লক্ষ্যভেদ। বন্ধুদের বলতেও পারেননি সন্দীপ, কী হয়েছে, কাঁদতে কাঁদতে ছুটে পালিয়েছেন স্টেজ থেকে নেমেই।
সন্দীপের পরিবার টাকা দিতে না পারলেও সন্দীপের ডিগ্রি পাওয়ার অধিকার আছে কি না, এ নিয়ে নানা বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু সে সবের বাইরেও একটা সার সত্য আছে। গত দু’এক বছরে টিস-এর মতো বহু প্রতিষ্ঠানেই তফসিলি জাতি-জনজাতির ছাত্রছাত্রীরা এই একই অপারগতার সামনে পড়ছে, পয়সা দিতে না পেরে পড়া শেষ করতে পারছে না। মোদী সরকারের আমলে চুপচাপ উঠে যাচ্ছে তাদের স্কলারশিপ। এসসি এসটি স্কলারশিপ এখন আগের চেয়ে অনেক কম, প্রায় তেরো কোটি টাকার বৃত্তি আটকে গিয়েছে। টিস-এর মতো প্রতিষ্ঠানে ২০১৫ সালের আগে নিয়ম ছিল, সমস্ত দলিত ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অনুন্নত গোষ্ঠীর ছাত্রদের টুইশন ও হোস্টেল ফি ‘ওয়েভ’ বা মকুব হবে। নতুন নিয়ম বলছে, সকলের এক টাকা, দিতে না পারলে কড়ায় গণ্ডায় অপমান। কংগ্রেসের তফসিলি বিভাগের চেয়ারম্যান কে রাজু হিসেব দিয়েছেন, কত লক্ষ অভাবী পরিবার মাসিক বৃত্তি উঠে যাওয়ার ফলে এখন গভীর সংকটাপন্ন।
তত অভাবী না হলেও অপমান করার যথাযথ বন্দোবস্ত আছে। ২০১৬ সালে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রোহিত ভেমুলা আত্মঘাতী হন তাঁর রাজনৈতিক মতামত কর্তৃপক্ষের না-পসন্দ্ হওয়ায় অর্থবৃত্তি বন্ধ হয়ে গেলে। ২০১৭ সালে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির দলিত ছাত্র মুথুকৃষ্ণন জীবনান্তম আত্মঘাতী হন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতবৈষম্যের শিকার হয়ে। ওই বছরই জেএনইউ-এর সেন্টার ফর ইংলিশ স্টাডিজ-এর সত্যব্রত দাস প্রফেসর পদে প্রোমোশন পাননি তাঁর দলিত পরিচয়ের কারণে। ইন্টারভিউয়ে জেএনইউ-এর নতুন (কেন্দ্র-প্রীতিভাজন) উপাচার্য নাকি পদে পদে তাঁকে অপমান করেন, তিনি কথা বলতে শুরু করলেই ‘ওকে ওকে’ বলে থামিয়ে দেন, অন্যদের কথা না শুনে তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করেন। জেএনইউ-এ গবেষণার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় এখন পুরো জোরটাই ইন্টারভিউ রাউন্ডের উপর, এটা জেনেই যে এসসি এসটি ওবিসি প্রার্থীরা এই রাউন্ডে সাধারণত কম নম্বর পান। সেখানকার তফসিলি শিক্ষকরা সকলে মিলে উপাচার্যের সঙ্গে এখনকার বর্ধিত বৈষম্যের পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে চেয়ে ব্যর্থ। ভিসির সময় নেই।
শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নতুন নীতিতে এর পর অধ্যাপক নিয়োগের সময় তফসিলি আসন সংরক্ষণের হিসেবটা গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপাতের বদলে প্রতিটি বিভাগের ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে করা হবে। এটাও কি এই ‘বড়’ গল্পেরই অংশ নয়? অঙ্ক তো বলছে, এই সংস্কার হলে সামগ্রিক হিসেবে সংরক্ষণ-নির্ভর প্রার্থীদের নিয়োগ অনেকটাই কমে যাবে। যেমন, যে সব বিভাগে মাত্র একটি-দুটি পূর্ণ অধ্যাপক পদ, সেখানে কোনও তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত প্রার্থী তাঁর গোটা জীবদ্দশাতেও সেই পদের নাগাল পাবেন না।
লক্ষণীয়, এপ্রিল মাসে যে এসসি এসটির প্রতি হিংসা-বিরোধী (প্রিভেনশন অব অ্যাট্রসিটিজ) আইনের সংস্কার নিয়ে দেশ জুড়ে তাণ্ডব চলল, সেই আইনটি দিয়ে কিন্তু মুকেশ-হত্যা ছাড়া এই ঘটনাগুলির আর কোনওটারই প্রতিকারে পৌঁছনো যেত না। ২০১৫ থেকে ২০১৮: এই পরিবর্তনশীল ভারতে দলিতবিরোধী হিংসা ও বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃত ও প্রাত্যহিক ভাবে চর্চিত। এটাই, যাকে বলে, নতুন স্বাভাবিকতা (নিউ নর্মাল)। এই তো, মে মাসের গোড়ায় বিহারের প্রাক্তন স্পিকার উদয়নারায়ণ চৌধুরি বিজেপি-শরিক নীতীশ কুমারের সঙ্গ ছেড়ে দিলেন, লাগাতার দলিত-নিগ্রহে এনডিএ-র যোগসাজশ সহ্য করতে না পেরে।
চার বছর আগে নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনে জিতেছিলেন ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ বলতে বলতে। আগামী এক বছর তাঁর কাজ— দলিতদের বোঝানো যে, দলিত রাষ্ট্রপতি নিয়োগ, দলিত আইকন অম্বেডকরের মূর্তি নির্মাণ, তাঁর নামে মুদ্রা প্রচলন, দলের প্রচারে গিয়ে দলীয় সভাপতির দলিত বাড়িতে দুপুরের খাওয়া: এই সবই হল সত্যিকারের ‘দলিত বিকাশ’-এর পথ। আর সবই মায়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy