মহারাষ্ট্রে নিহত ‘মানুষখেকো’ বাঘ অবনীর মৃতদেহ। ফাইল চিত্র
মানুষখেকো হয়ে ওঠার কারণে মহারাষ্ট্রে অবনী নামের বাঘিনী হত্যা এবং উত্তরপ্রদেশের দুদুয়া ব্যাঘ্র প্রকল্পে গ্রামবাসীদের হাতে বাঘের মৃত্যুর ঘটনার আঁচ পড়েছে উত্তরবঙ্গেও। এই বাঘহত্যা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে। নেওরা ভ্যালি, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের মতো বাঘেদের বিচরণভূমি থেকেও বাঘেদের জন্য একই ধরনের উদ্বেগের সুর ভেসে আসছে। এ ভাবে অবনী নামের বাঘিনী হত্যার সরকারি সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছেন না উত্তরবঙ্গের পরিবেশকর্মীরা। অবনীর দু’টি ১০ মাসের শাবকের জন্যও ব্যথিত তাঁরা। এই মৃত্যু কি কোনও ভাবে এড়ানো যেত না? এমন প্রশ্নও তুলছেন পরিবেশবিদ এবং পরিবেশকর্মীরা।
উত্তরবঙ্গের পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ‘ন্যাফ’-এর মুখপাত্র অনিমেষ বসু পুরো ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “গুলি করে হত্যা করা যায় যদি, ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে আটক করা গেল না কেন? এটা একেবারেই বোধগম্য হচ্ছে না!” পরিবেশে যে ভাবে বাঘ একের পর এক কমে আসছে বাঘের সংখ্যা, সেখানে ভবিষ্যতে বাঘ নিয়ে আমাদের গর্বের জায়গা আর না থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা তাঁর। উত্তরপ্রদেশের দুদুয়া ব্যাঘ্র প্রকল্পে মাঝবয়সি এক ব্যক্তিকে বাঘ আক্রমণ করেছিল। পরে ওই ব্যক্তি মারা যান। এর পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামবাসীরা। ঘটনার বদলা নিতে জঙ্গলে ঢুকে বাঘকে খুঁজে বার করে তাকে মেরে ফেলেন তাঁরা। এক মাসের মধ্যে এই দু’টি বাঘের হত্যাকে ঘিরে তাই নানা স্তরে প্রশ্ন উঠেছে। অনিমেষ বসু লালগড়ের বাঘের ক্ষেত্রেও সার্বিক সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে প্রশাসনিক কঠোরতার অভাবকেও দুষেছেন। দুদুয়ার মতোই লালগড়ে দিবালোকে বাঘ হত্যা করা হয়। কিন্তু বাঘের মতো প্রাণীকে হত্যা করার অপরাধে যেখানে নজিরবিহীন শাস্তির প্রয়োজন ছিল, সেখানে কার্যত চাপের কাছে পুলিশ ও বন দফতরের নত হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানে গত দেড় বছর ধরে বারবার বাঘ দেখা গিয়েছে। ওই এলাকার সার্বিক সংরক্ষণের দাবি করে আসছিলেন স্থানীয় পরিবেশপ্রেমীরা। কিন্তু এখন তাঁরা নেওড়া ভ্যালির বাঘের নিরাপত্তা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন। কারণ, উত্তরবঙ্গে চিতাবাঘ হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ডুয়ার্সের পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ‘ন্যাস’-এর কো-অর্ডিনেটর নাফসার আলি বলেন, “বাঘ রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের নানা স্তরে কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞেরা ভাবনাচিন্তা করছেন। অবনীর মৃত্যু তাঁদের সকলের আত্মবিশ্বাসে চির ধরাতে পারে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেছে, কমিটি গঠন করেছে। এ সবই ভাল কাজ। কিন্তু তাপ পরেও বাঘের মৃত্যু কেন ঠেকানো গেল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।”
অবনীর ঘটনায় শুধু পরিবেশপ্রেমীরাই নন, দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন ডুয়ার্সের জনপ্রতিনিধিরাও। আলিপুরদুয়ারের বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “অবনীর শাবক দু’টোর পরিচর্যায় যাতে অবহেলা করা না হয়, সেটাই এখন দেখার বিশয়। আমাদের উত্তরের বনজঙ্গল জুড়ে বন্যপ্রাণ ছড়িয়ে রয়েছে। আমরাও বুনোদের নিয়ে একসঙ্গে আছি। বেঙ্গল সাফারির মতো উন্মুক্ত এলাকা তৈরি হয়েছে। তাই মৃত বাঘিনী অবনীর শাবকদের যদি আমাদের এখানে পাঠানো হয়, তা হলে যত্নের কোনও ত্রুটি হবে না।”
তবে, বিরুদ্ধমতও রয়েছে। বন দফতরের সাম্মানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাক্তন সেনা মেজর অমরজিৎ সিংহ চহ্বাণের মতো অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে, একান্ত বাধ্য না হলে এই ধরনের খুনের ফরমান জারি করা হয় না। তাঁদের বক্তব্য, সাধারণ গ্রামবাসীরাও অনেক ক্ষেত্রে রোষের বশে অন্য বাঘ বা হাতির ক্ষতি করে ফেলতে পারেন। তাই সব মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ডুয়ার্সের হাতিদের ক্ষেত্রে গত দু’দশকে তিনটি হাতির ক্ষেত্রে বন দফতরের তরফে মৃত্যু পরোয়ানা জারি ও কার্যকর করা হয়। একাধিক মানুষ খুন করে এখনও জঙ্গলে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন হাতিও বেশ কিছু রয়েছে। এই খুনে হাতিদের ছবি সংবলিত তালিকাও বন দফতরের কাছে রয়েছে। কিন্তু তাদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করার কোনও পরিকল্পনা আপাতত নেই বলেই বন দফতর সবত্রের খবর।
বুনো জন্তুদের হামলার চরিত্র বুঝতে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে হয়৷ এমন অনেক ঘটনা ঘটে, বনকর্মীদের কাছে যার কোনও ব্যাখ্যা থাকে না। লাটাগুড়ি জঙ্গলেই যেমন একটি পরিবারের তিন জনকে তিন বছরে ভিন্ন ভিন্ন হামলায় শিংয়ের গুঁতোয় মেরে ফেলে এক বাইসন। এর কারণ এখনও বুঝে ওঠা যায়নি। তাই বুনোদের গতিবিধি বুঝতে আরও বিশ্লেষণ এবং গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy