Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

বাঁকুড়ায় গাঁধীবাদী রাজনীতির পুরোধা ছিলেন অনিলবরণ রায়

বাঁকুড়া শহরে প্রথম রাজনৈতিক সভাটি আয়োজিত হয় তাঁরই হাত ধরে। বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র না হয়েও বাঁকুড়ায় গাঁধীবাদী রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ছিলেন। পরবর্তীতে লাভ করেন শ্রীঅরবিন্দের সান্নিধ্য। অনিলবরণ রায়ের বর্ণময় জীবন নিয়ে লিখছেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়‘বাঁকুড়া জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি’ বইয়ে রামকৃষ্ণ দাস লিখেছেন, ‘অনিলবরণ রায় এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন এবং তিনিই যে বাঁকুড়ায় নির্ভীক ও ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা হইবেন এই সভাতেই তাহা সুস্পষ্ট হয়’।

অনিলবরণ রায়। ছবি: লেখক

অনিলবরণ রায়। ছবি: লেখক

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯ ০১:৩৯
Share: Save:

বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র নন। অথচ, বাঁকুড়ায় গাঁধীবাদী রাজনীতির তিনি অন্যতম পুরোধা। ১৯২০ সালে লোকমান্য তিলকের প্রয়াণের পরে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সারা ভারতের সঙ্গে বাঁকুড়াতেও এক জাতীয় সচেতনতামুখী আন্দোলন দানা বাঁধে। বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান কলেজের (অধুনা খ্রিস্টান কলেজ) ছাত্রেরা অধ্যক্ষের নিষেধ অগ্রাহ্য করে কলেজে সমাবেত হন এবং মিছিল করে দোলতলায় এক জনসভায় যোগদান করেন।

বাঁকুড়া শহরে এটিই ছিল প্রথম রাজনৈতিক সভা। ‘বাঁকুড়া জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি’ বইয়ে রামকৃষ্ণ দাস লিখেছেন, ‘অনিলবরণ রায় এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন এবং তিনিই যে বাঁকুড়ায় নির্ভীক ও ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা হইবেন এই সভাতেই তাহা সুস্পষ্ট হয়’।

১৮৯০ সালের ৩ জুলাই বর্ধমানের গুইর গ্রামে অনিলবরণের জন্ম। বাবা, নবকুমার রায়। যে বছরে বিএ পরীক্ষা, বাবা মারা যান। অভাবের সংসারে তখন বিধবা মা, তিন নাবালক ভাই, তিন বোন ও ঠাকুমা। কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাশ করার পরে জনৈক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট প্রচুর যৌতুক-সহ তাঁর মেয়ের সঙ্গে অনিলবরণের বিয়ে দেন। এতে অনিলবরণের পারিবারিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।

এমএ পাশ করার পরে, বীরভূমের হেতমপুর রাজ কলেজে তর্কশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর পরে ইংরেজি সাহিত্যেও এমএ পাশ করেন। এই সময়ে অনিলবরণ রামদাস বাবাজির শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গৃহত্যাগে উদ্যোগী হন। তবে গুরুর আদেশে তিনি আবার শিক্ষক জীবনে ফিরে আসেন। এর পরে বন্ধু জিতেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে ওয়েসলিয়ান কলেজে যোগ দেন।

ইতিমধ্যে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ও ‘রাওলাট আইন’-এর প্রতিবাদে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ডাকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯২০ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছাত্রদের ইংরেজ পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দেন। তাতে সাড়া দিয়ে ওয়েসলিয়ান কলেজের ছাত্রেরা কলেজ ছাড়েন। তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অনিলবরণ কলেজের কাজে ইস্তফা দিয়ে জাতীয় বিদ্যালয় তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। অনিলবরণের এই সিদ্ধান্তের মূল্যায়নে রামকৃষ্ণ দাসের মন্তব্য, ‘অভাবী সংসারের গুরুদায়িত্ব উপেক্ষা করিয়াই তিনি নিঃস্ব হইয়াও দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করিলেন’।

অনিলবরণ রায় ছিলেন বাঁকুড়া জেলা কংগ্রেসের প্রথম সম্পাদক। গাঁধীর অনুকরণে তিনিও কেবল হাঁটু পর্যন্ত খদ্দরের কাপড় পরতেন। জানা যায়, ‘সারথি’ নামে একটি পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করতেন। ১৯২১-এ ‘তিলক স্বরাজ ভাণ্ডার’-এর জন্য বাঁকুড়ায় অর্থ সংগ্রহে আসা দেশবন্ধুর সঙ্গে অনিলবরণের যোগাযোগ তৈরি হয়। অনিলবরণের যোগ্যতা দেখে দেশবন্ধু তাঁকে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি’-র সম্পাদকের পদ দিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসেন।

১৯২২-এ চৌরিচৌরার ঘটনায় গাঁধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে চিত্তরঞ্জন দাশ গাঁধীবাদী রাজনীতিতে আস্থা হারিয়ে স্বরাজ্য দল গঠন করেন। ‘ভারত শাসন আইন’ মোতাবেক ১৯২৩ সালের নভেম্বরে নির্বাচনে বাঁকুড়া সদর বা বাঁকুড়া পশ্চিম কেন্দ্রে অনিলবরণকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য চিত্তরঞ্জন দাশ নির্দেশ দেন। অনিলবরণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ী হয়ে আইনসভার সদস্য হন। এর পরে ১৯২৪-এ তারকেশ্বর সত্যাগ্রহে যোগদান করে দু’বছর কারাবাস করেন। এই সময়ে রাজবন্দি হিসেবে তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গী ছিলেন।

ক্রমে স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিতে আস্থা না রাখতে পেরে অনিলবরণ শ্রীঅরবিন্দের জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পুদুচেরির আশ্রমে চলে যান। সময়টা ১৯২৪-এর মে। আশ্রমে থাকার সময়ে শ্রীঅরবিন্দের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন তিনি। আশ্রমের অন্যতম প্রবীণ আশ্রমিক শ্রীনীরদবরণ লিখেছেন, ‘আমি যখন প্রথম আশ্রমে এসে এক মাস অবধি ছিলাম তখন অনিলবরণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সুপুরুষ, উজ্জ্বলকান্তি, দীর্ঘদেহী; একবার দেখলে তাঁর চেহারা ভোলা যায় না। সে সময় আশ্রমের অগ্রগণ্য সাধকদের মধ্যে তিনি অন্যতম’।

শ্রীঅরবিন্দের ‘Essays on the Gita’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা অবলম্বনে অনিলবরণ বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর ‘সম্পাদনা’ লিখেছিলেন। আশ্রমে শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে অনিলবরণের চিঠির আদানপ্রদান হত। কারাবাসের পরে শ্রীঅরবিন্দের বিখ্যাত ‘উত্তরপাড়া স্পিচ’-এর বঙ্গানুবাদ করেছিলেন অনিলবরণ।

শ্রীঅরবিন্দের মৃত্যুর পরে ১৯৭১ সালে অনিলবরণ পুদুচেরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল, দু’ভাগে বিভক্ত বাংলাকে আবার এক করা। অখণ্ড ভারত গঠনেরও অভিপ্রায় ছিল তাঁর। সেই লক্ষ্যে কলকাতায় এসে তিনি দলও গঠন করেন। তবে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১৯৭৪-এর ৩ নভেম্বর ৮৪ বছর বয়সে কলকাতায় প্রয়াত হন তিনি।

লেখক বাঁকুড়ার সংস্কৃতিকর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

Anil Baran Roy Gandhian Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy