এর আগে বার দুয়েক এই কাগজের এই জায়গাতেই আপনার কাছে এই আবেদন করেছি। কোনও কাজ হয়নি। আবারও করছি এই ভরসায় যে এ বার নিশ্চয়ই কাজ হবে। আর, আপনার কাছেই করছি এই কারণে যে একমাত্র আপনিই পারেন কাজটা করে দিতে। ইতিহাসের এ এক অদ্ভুত খেলা যে, কোনও কোনও সময় কোনও এক দিন ভোটে-জেতা নেতাই ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেন। আপনি গত বিধানসভা ভোটে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, তার ফলে আপনি সেই রকম ব্যক্তিক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। ইতিমধ্যে দু’টি সিদ্ধান্তে আপনি এমনই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। একটি বেসরকারি হাসপাতালের অনৈতিক মুনাফাবৃত্তি রোধ করা। আর দ্বিতীয়টি, কৃষিজমির খাজনা মকুব। দু’টি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনেক পণ্ডিতী যুক্তি দেওয়া যায় ও দু’টি কাজকেই অনেক খাটো করে ফেলা যায়। ক্রীতদাস প্রথা লোপের আইন পাশ করায় এব্রাহাম লিঙ্কনের বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ নেতারাও কেউ কেউ ছিলেন। লিঙ্কন বলেছিলেন, যুক্তির চেয়ে বড় নৈতিকতা। যে জন্য তাঁকেও মরতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে আসছেন। তাঁর সফরের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য, তিস্তা ব্যারেজের ফলে তিস্তার জল বাংলাদেশে বইয়ে দেওয়ায় প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পথে যে বিঘ্ন তৈরি হয়েছে ও জল ছাড়ার একচেটিয়া অধিকার যে ভারতের (পশ্চিমবঙ্গের) হাতে চলে গেছে, সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় চাষের প্রয়োজনীয় জল পাওয়া।
বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী যদি এই চুক্তি হয় তা হলে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার সমর্থন অনেক নিশ্চিত হবে বলে অনেকে মনে করেন। যদি তা না হয়, তা হলে হাসিনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সুবিধে পাবে। বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তরিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভারতের (পশ্চিমবঙ্গের) পক্ষে খুব, খুব, খুবই দরকার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ওপর আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করেছে। তাঁদের রাজনৈতিক কৌশল অনুযায়ী, বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমাও যত বেশি দুর্বৃত্তনিয়ন্ত্রিত হবে, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি করা তত সুবিধেজনক হবে। তিস্তা চুক্তি না হলে নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি’র সবচেয়ে সুবিধে। চুক্তি হলে শেখ হাসিনার পক্ষে সীমান্তকে দুর্বৃত্তমুক্ত করা সহজতর হবে। তাতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো।
নদীর জল নিয়ে এমনটা হওয়ার কথা নয়। তখনই কথা হয়, কথা বানিয়ে তোলা হয়, যখন নদীর জল, আকাশের হাওয়া, প্রাকৃতিক অরণ্য, পাহাড়ের বরফ— এমন সব নৈসর্গিক ও স্বাভাবিক বিষয়ের ওপর রাষ্ট্র তার দখল কায়েম করে। সমুদ্রের জলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দখলদারি জারি করেই সাম্রাজ্যবাদ শুরু।
তিস্তা ব্যারেজ যদি না হত তা হলেই তো এই সমস্যা তৈরি হত না। বামফ্রন্টের এ এক মহা অপকীর্তি। আমি তখনও ও এখনও বামফ্রন্টের সমর্থক। তখনও আমি জনে জনে বলেছি, এ কাজ করবেন না। একটা নদীকে মারবেন না, তিস্তায় ব্যারেজ বানাবেন না। তখন বামফ্রন্ট নদী-সংযোগের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় মাতাল। তিস্তার জল মহানন্দায় ফেলে মহনন্দার খাত দিয়ে গঙ্গায় ফেলা হবে। তাই তিস্তা ক্যানাল কাটা হল। হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের টাকাও এসেছিল। টাকা যদি গৌরী সেন দেন, একটা নদীর দানসাগর শ্রাদ্ধ করতে বাধা কোথায়? সরকারি প্রশাসনিক উপদেষ্টা ও উচ্চপদস্থ কর্মীদের এই এক মস্ত সুবিধে যে তাঁদের কোনও কৃতকর্মের জন্য কোনও কৈফিয়ত দিতে হয় না। তাঁদের সমস্ত কাজ হিন্দুদের অদৃশ্য পূর্বজন্মের কৃতকর্ম।
তখন আমরা বলেছিলাম, গাজোলডোবা থেকে বাংলাদেশ সীমা পর্যন্ত দু’পারের কৃষিজমি তো মরুভূমি হয়ে যাবে। তা-ই হয়েছে। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে। তিস্তার সমতল-প্রসার সাড়ে তিন মাইল থেকে এমনকী দশ মাইল পর্যন্ত প্রসারিত। সেই বিস্তার জুড়ে গ্রাম বসে গেছে। আমরা তখন বলেছিলাম, সেবক থেকে সমতলে নেমে তিস্তার সেই পাহাড়ভাঙা স্রোতের ঐরাবতী ধাক্কায় পাহাড়, পাহাড়-মাটি ও পাথর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যে নদীর বিস্তার তৈরি হচ্ছে, সেই বিস্তারের টানে লিস-ঘিস-নেওড়া, চেল থেকে শুরু করে দাদাই ও ঘরঘরিয়া, গয়েরকাটা-নানাই মিলিয়ে দুদুয়া, আংরাভাসা, ধরধরা, করলা, ধরলার জল নিয়ে এই এক নদী তিস্তা নিজেকে শতস্রোতা করে তুলে সন্নিহিত পূর্বপাড়ের ডুর্য়াসের ফরেস্ট ও কৃষিক্ষেত্র তৈরি করতে করতে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়েছে। গাজোলডোবার দক্ষিণের এই তিস্তাই তো তিস্তা। সেই তিস্তাকেই মেরে ফেলা হল।
তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার খুলেও দেখিয়েছিলাম, সাহেবদের তৈরি গেজেটিয়ারও দেখিয়েছিলাম। সেখানে এই সব কথা লেখা আছে। আপনি ইচ্ছে করলে বরুণ দে সম্পাদিত সেই গেজেটিয়ার এখনও পড়ে নিতে পারেন।
আপনার কাছে একটিই আবেদন। আপনি যেমন হাসপাতালকে রোগীর কাছে ফিরিয়ে দিলেন, যেমন চাষের জমিকে চাষির কাছে ফিরিয়ে দিলেন, তেমনই নদীকে, তিস্তার মতো মহৎ নদীকে নদীতে ফিরিয়ে দিন। শেখ হাসিনার সঙ্গে আপনার কথাবার্তায় আপনি ঘোষণা করুন, নদীকে আটকাবার জন্য ব্যারেজ থাকবে না। নদী ব্যারেজহীন, নদী তার প্রকৃতিক প্রবাহ পথে ফিরে যাক। নদী কেন এমন সীমান্ত মানবে, যে সীমান্ত সে নিজে তৈরি করেনি।
আপনার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞরা আপনাকে অনেক পাল্টা যুক্তি দেবেন। আমাকে যদি ডাকেন, আমি তাঁদের সঙ্গে সেই যুক্তিতর্কে উপস্থিত থেকে আমার কথাগুলো বলতে রাজি আছি। কিন্তু সেই তর্কে তিস্তাকে মরে যেতে দেবেন না। আপনি বলুন, যুক্তির চাইতে নৈতিকতা বড়। তিস্তাকে পুনর্জন্ম দেওয়ার সুযোগ কার ভাগ্যে জোটে, বলুন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy