জ্বলছে আমাজনের অরণ্য। ছবি: আইস্টক
এ বছরে পৃথিবীব্যাপী নানা বনাঞ্চলে যে অগ্নিকাণ্ডগুলি ঘটেছে তা আমাদের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে আমাজনের আগুন বিশ্বব্যাপী ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। তবে আগুন লাগাটা নতুন নয়। ফি-বছরই আমাজনের বনানীতে শুষ্ক মরসুমে আগুন লাগে। তবে এ বারের আগুনের প্রকৃতি কিছুটা আলাদা। তাই একে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ‘অগ্নিকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করছেন। এতে তীব্র আগুনের সৃষ্টি হয় এবং সারি সারি গাছ দ্রুত আগুনের কবলে পড়ে। এ বারে আগুনে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘লিগাল্ আমাজনিয়া’র, যা ব্রাজিলের অন্তর্গত।
এই বনাঞ্চলের ভাগীদার হল বিশ্বের ন’টি দেশ। তার মধ্যে ব্রাজিলের ভাগই হল প্রায় ৫৮.৪ শতাংশ, পেরু ১২.৮ শতাংশ, বলিভিয়া ৭.৭ শতাংশ, কম্বোডিয়া ৭.১ শতাংশ, ভেনেজুয়েলা ৬.১ শতাংশ, গায়ানা ৩.১ শতাংশ, সুরিনাম ২.৫ শতাংশ এবং ইকুয়েডর ১ শতাংশ অঞ্চলের মালিক। ব্রাজিলের ‘লিগাল্ আমাজনিয়া’-র চারটি রাজ্য হল—মাজোনাস, রনডোনিয়া, মাটো গ্রাসো এবং পারা। এই অগ্নিকাণ্ডে চারটি রাজ্যে ৪০ হাজারের বেশি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমাজনের অরণ্যকে ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ বৃষ্টিবহুল অরণ্য’ বলা হয়। ৬৭ কোটি হেক্টর বা ২ কোটি ৬০ লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত এই অরণ্যকে অনেকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলেন। সমুদ্রের পরে পৃথিবীর ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন শোষক’ হল আমাজনের অরণ্য। বিশ্বের ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড এই অরণ্যের উদ্ভিদ শোষণ করে। এই বন থেকে বিশ্বের কুড়ি শতাংশ অক্সিজেন পাওয়া যায়। তবে পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই বনাঞ্চল যে বিশ্বের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। পৃথিবীর মোট জীব-বৈচিত্রের প্রায় ১০ শতাংশের আধার এই অরণ্য। এখানে প্রায় তিরিশ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। রয়েছেন দশ লক্ষ ক্ষুদ্র জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষও। এই বনানীতে ৪০ হাজার প্রজাতির গাছ রয়েছে। আরও অনেক ধরনের গাছ ও প্রাণী প্রজাতিও রয়েছে যাদের সম্পর্কে পুরো তথ্য আমরা সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। আমাজন নদীতেও মাছের নানা প্রজাতির বাস। এই নদীতে রয়েছে পৃথিবীর মোট মাছের প্রজাতির একটি বড় অংশ। রয়েছে নানা ধরনের জলচর, স্তন্যপায়ী প্রাণী, বাদুর, ইঁদুরের নানা প্রজাতিও। পরিসংখ্যান থেকে জানা গিয়েছে ১৯৭০ সাল থেকে ব্রাজিল এই অরণ্যের প্রায় ১২ শতাংশ অঞ্চল ধ্বংস করেছে। যার পরিমাণ হল ৭৭.৭ লক্ষ হেক্টর। বনভূমি নষ্ট হওয়ার কারণে এই অঞ্চলকে বাঁচাতে ২০০৪ সালে গড়ে তোলা হয় ‘ফেডারেল অ্যাকশন প্লান ফর প্রোটেকশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অব ডি-ফরেস্টেশন ইন আমাজন’। এই সংস্থার উদ্যোগে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রায় ৮৩.৫ শতাংশ বনভূমির ক্ষয় রোধ করা গিয়েছিল। তবুও আগুন লাগল।
ব্রাজিলের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পেস রিসার্চ’ তাদের রিপোর্টে বলল, উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছিল আমাজনের বনাঞ্চলে অন্তত ৭৫ শতাংশ গাছপালা দাবানলে পুড়ছে। এর আগে ২০১৫ সালে ‘ইনপে’ সংস্থাটি পাঁচটি পরিকল্পনার সাহায্যে দাবানল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু করে। দেখা গিয়েছে সাধারণ ভাবে ফি-বছর জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে আমাজনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিন্তু এ বছর জানুয়ারি থেকেই আগুন শুরু হয়েছে। এই আগুনের মোট সারির সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। একা আমাজনের বনাঞ্চলে তা ৪০ হাজারের কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। ২০১৩ সালের পরে এই পরিমাণ সারির সংখ্যা এই প্রথম। তাই বিশ্ববাসী এতে চিন্তিত। অগস্টের প্রথম দিক থেকে অল্প বিস্তর করে আগুনের খবর সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমগুলির সৌজন্যে সামনে আসতে থাকে। ১১ অগস্ট ব্রাজিল সরকার এই রাজ্যগুলিতে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং স্কুল, কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে আলোচনাও নিষিদ্ধ করে। তার পরে ২৪ ও ২৫ অগস্ট আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হতে শুরু করলে দেখা যায় যে ব্রাজিল, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ের মতো তিনটি দেশ এই অগ্নিকাণ্ডের জেরে ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলিভিয়ার সীমান্তে সাভানা এবং ট্রপিক্যাল বনাঞ্চলের অংশবিশেষ এই অগ্নিকাণ্ডের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৭ অগস্ট কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ধেয়ে চলে আমাজনের উত্তর পশ্চিম অংশ বরাবর। সাও পাওলোর দিকে তা প্রবাহিত হলে মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এই বনাঞ্চলের ধ্বংসের পিছনে মূল কারণ কী সে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে উঠে আসছে নানা মত। এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে প্রথমেই যে বিষয়টির কথা উঠে আসে সেটি হল ‘স্ল্যাশ অ্যান্ড বার্ন’ অর্থাৎ বনকাটা এবং পোড়ানোর কথা। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্রাজিলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বনাঞ্চলকে কৃষিযোগ্য ও পশুচারণযোগ্য জমিতে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছে। জানুয়ারিতে ভোটে জিতে ব্রাজিলের নতুন রাষ্ট্রপতি জাইর বোলসোনারো বনভূমি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। আর্থিক উন্নতির জন্য বনাঞ্চল ব্যবহার করতে শুরু করায় এমনিতেই আমাজনের ভারসাম্যের উপরে বিশাল চাপ তৈরি হচ্ছিল। স্থানীয় জনজাতিরা যে ভাবে বনাঞ্চলের সম্পদ ব্যবহার করতেন তার থেকে সরে এসে এই বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে সে দেশের পরিবেশপ্রেমীদের সঙ্গে সরকারের একাধিক বার সঙ্ঘাত ঘটেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কারে মরিয়া হয়ে ওঠা প্রশাসন কোনও সতর্কতায় কর্ণপাত করেনি। ফলে, অল্প সময়ের মধ্যে আমাজনের বন বিপন্ন হয়ে পড়ল। ব্রাজিলের বনভূমির অবক্ষয় নিয়ে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপুঞ্জ পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না করার করলে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ব্রাজিল থেকে গোমাংস আমদানি করা বন্ধের ডাক দিয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলে ব্রাজিলের উপরে চাপ বাড়ে। জি-৭ এই আগুনের মোকাবিলায় অর্থ সাহায্য করতে চাইলে তা প্রত্যাখান করে ব্রাজিল। কলোম্বিয়া প্রশাসনের সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর যে হারে ব্রাজিলের বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাজনের বনাঞ্চল অর্ধেক হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে ব্রাজিল প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ হয়তো করবে কিন্তু এ ভাবে চাপ দিয়ে ব্রাজিলের মতো একটি দেশকে সাময়িক ভাবে বাধ্য করলেই কি সমস্যা সমাধান হবে? প্রশ্নটা থেকেই গেল?
কারণের, অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় আর্থিক দিক থেকে ব্রাজিল ততটা উন্নত নয়। সে দেশের সম্পদ বলতে যেটুকু তা মূলত বন ও কৃষিকেন্দ্রিক। ফলে সে দেশের উন্নতির জন্য ফের যে ভবিষ্যতে বনাঞ্চলমুখী হতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার জেরে ফের বিপদের আশঙ্কা উঁকি দেবে। দেখা দেবে মানুষ-অরণ্য দ্বন্দ্ব। ফলে এই দ্বন্দ্বকে কাটিয়ে কী ভাবে সে দেশের আর্থিক উন্নতি সম্ভব তার রূপরেখা তৈরি করতে না পারলে যে ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না সে কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
শিক্ষক, পরিবেশ-বিজ্ঞান বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy