মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী নোংথোম্বাম বীরেন সিংহ। —ফাইল চিত্র।
আক্রমণ আসছে মুহুর্মুহু। কখনও মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসছে বিপজ্জনক পাস, কখনও রাইট উইং ধরে দৌড় লাগাচ্ছেন বিপক্ষের অভিজ্ঞ অধিনায়ক। কখনও লেফট উইং-এর অরক্ষিত এলাকা থেকে গোলমুখী শট। আর এক দুঁদে ডিফেন্ডার হার-না-মানা জেদ নিয়ে ঠেকিয়ে চলেছেন দলের পতন, নিজের পতনও! গত ছ’বছর ধরে নিজের ফুটবল জীবনের ডিফেন্ডারের ভূমিকাটাই ক্রমাগত কাজে লাগছে তাঁর।
এখন নাহয় মণিপুরের ফুটবলাররা দেশের ময়দান কাঁপাচ্ছেন। কিন্তু রাজ্যের প্রথম ফুটবলার হিসাবে ১৮ বছরের নোংথোম্বাম বীরেন সিংহই প্রথম রাজ্যের বাইরে খেলতে গিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে মোহনবাগানকে হারিয়ে কাপ জেতা বিএসএফ দলের ডিফেন্ডার ছিলেন বীরেন। রাজ্য দলের হয়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি খেলেছেন।
কর্মসূত্রে ছিলেন সীমান্ত সুরক্ষায়, ক্রীড়াসূত্রে ডিফেন্ডার। পরে হন সাংবাদিক-সম্পাদক। তাই মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন, রক্ষণের দুর্বলতা বুঝে তা মেরামত করতে জানেন। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের আক্রমণ কখন, কী ভাবে, কতটা প্রাবল্যে আছড়ে পড়ে কতটা ক্ষতি করতে পারে— জানেন।
সে রাজ্যে ৩ মে থেকে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী হলে কী করতেন কে জানে। বীরেন কিন্তু দলের হাই কমান্ডের নির্দেশ আসার পরেও পদত্যাগপত্র ছিঁড়ে ফেলার চিত্রনাট্য তৈরিতেই বেশি মন দিতে পারেন। সাড়ম্বরে কনভয়ে বার হন পদত্যাগের উদ্দেশ্যে। রাস্তা রোখেন তাঁরই অনুগত মহিলাবাহিনী। ‘অনন্যোপায়’ বীরেন ‘জনতার চাপে’ পদত্যাগপত্র রাজ্যপালের বদলে অনুরাগীদের হাতে তুলে দেন। প্রতিটি অক্ষর অটুট রেখে, সুচারু দক্ষতায় ছেঁড়াসেই পদত্যাগপত্র ভাইরাল করে দেশকে ও দলকে বুঝিয়ে দেন: কী করবেন, জনতা তাঁকে চায়, তাই ইচ্ছে থাকলেও তাঁর পদ ছাড়ার উপায় নেই।
শুধু এই বারই নয়। গত ছ’বছরে, অন্তত তিন বার বীরেনের সরকার পড়ে যাওয়ার মুখে ছিল। কখনও বিদ্রোহ হয়েছে জোটের মধ্যে, কখনও দলের মধ্যেই। বীরেনের গদি কাড়তে তৈরি অন্তত তিন সতীর্থ। কিন্তু তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন উত্তর-পূর্ব রাজনীতির ‘চাণক্য’ হিসাবে খ্যাত, নেডা জোটের প্রধান হিমন্তবিশ্ব শর্মা। সেই হিমন্তই প্রতি বার বীরেনের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এ বারেও ব্যতিক্রম হয়নি।
অসমে হিমন্ত ও মণিপুরে বীরেনের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার রাস্তাটাও কার্যত এক। জার্নালিজ়মের ডিপ্লোমাধারী বীরেন ১৯৯২ সালে নাহারোলগি থৌডাং নামে নিজের সংবাদপত্র চালু করেন। ২০০১ পর্যন্ত তিনি সেই সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। এখন বীরেনের আমলে সরকার-বিরোধী মত প্রকাশ, লেখা প্রকাশের দায়ে বহু সাংবাদিক জেলে যাচ্ছেন। ২০০০ সালে এই বীরেনকেও একই ভাবে সরকার-বিরোধী খবর ছাপায় রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে জেল খাটতে হয়েছিল।
২০০২ সালে ডেমোক্র্যাটিক রেভলিউশনারি পার্টিতে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে আসেন তিনি। হেংগাং কেন্দ্র থেকে জিতে যান। ২০০৩ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়েই পেয়ে যান মন্ত্রিত্ব। ২০১৬ সালে হিমন্তের হাত ধরেই বীরেনের বিজেপি-গমন। ঠিক একই ভাবে, অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-এর সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইয়ের জেরে তার আগের বছরই কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন হিমন্ত।
২০১৭ সালের ভোটে মণিপুরে ২৮ আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দল হয়েও গদি বাঁচাতে পারেনি কংগ্রেস। হিমন্তর চালে ২১ আসন পাওয়া বিজেপি অন্যদের দলে টেনে সরকার গড়ে। মণিপুরে প্রথম বার বিজেপির সরকার হয়। নেতৃত্বে বীরেন। এর পর থেকে যখনই ‘বিপর্যয়’-এ পড়েছেন বীরেন, বিপত্তারণ হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন হিমন্ত। এমনকি বিজেপি বিধায়কদের গণ-পদত্যাগের জেরে বিজেপি সরকার যখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে, হিমন্ত-বীরেন তা আটকেছেন।
বীরেন মুখ্যমন্ত্রী হলে কেন্দ্রের সঙ্গে নাগা জঙ্গি সংগঠন এনএসসিএন আইএমের খসড়া শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। নাগা এলাকাগুলিকে এক ছাতার তলায় আনা হবে, মনে হচ্ছিল। তেমন হলে পার্বত্য মণিপুরের নাগা জেলাগুলি মণিপুর থেকে আলাদা হয়ে যেত। বীরেন বাধা দেন, নাগাদের মন পেতে প্রশাসনকে পার্বত্য এলাকার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ করেন। চালু করেন ‘গো টু হিলস’। বীরেন পরে মজা করে বলেছেন, মমতাদিদি তাঁর দেখাদেখিই বঙ্গে ‘দুয়ারে সরকার’ চালু করেছেন। কিন্তু গত বছর দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই বীরেন পাহাড়ের জমি দখলের অভিযানে নামেন। শুরু হয় মাদকের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। ফলে সরাসরি সংঘাত বাধে কুকিদের সঙ্গে।
এই যে এত প্রতিবাদের পরেও বিজেপি হাই কমান্ড বীরেনকে সরাতে পারছেন না, তার বড় কারণ মেইতেইদের মধ্যে বীরেনের জনপ্রিয়তা। তিনি এই লড়াইতে নিরপেক্ষতা রাখার চেষ্টা না করে মেইতেইদের পক্ষ নিয়েছেন প্রথম থেকে। রাজধর্মের তোয়াক্কা করেননি। এমনকি চলতি লড়াই ‘হিন্দু বনাম খ্রিস্টান’, ‘মন্দির বনাম গির্জা’র লড়াইয়ের চেহারা পেতে পারে, সেটা জেনেই কুকিদের বিরুদ্ধে লড়তে নামেন তিনি। সরকার ভেঙে ফেলে জবরদখল করা জমিতে তৈরি একের পর এক গির্জা। অথচ অদ্ভুত, কুকি-মেইতেই সংঘর্ষ যে কোনও ভাবেই ধর্মের সংঘাত নয়, তাও প্রতিষ্ঠা করতে তিনি মোটামুটি সফল। দলকে বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁকে সামনে রেখে লড়লে এক দিকে চাপের সামনে মাথা ঝোঁকানোর উদাহরণ তৈরি হবে না, অন্য দিকে তাঁকে সরিয়ে দিলে নতুন নেতা এই পরিস্থিতিতে সরকার চালাতে পারবেন না।
বোঝাতে পেরেছেন বলেই মনে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে এখন এন বীরেন সিংহ মণিপুরের রাজনীতিতে অপরিহার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy