মণীশ সিসৌদিয়া। ফাইল ছবি।
তিহাড়ের কুঠরিতে পাশে ভগবদ্গীতা আর সঙ্গে কিছু কাগজ কলম। এই সম্বল করে ক্রমশ ঘনঘোর ভবিতব্যের দিকে মণীশ সিসৌদিয়া। ক্ষমতার মাপকাঠিতে দিল্লির আপ সরকারের দু’নম্বর স্থানাধিকারী, ১৮টি মন্ত্রকের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্তের জাল ক্রমশ গভীর। আবগারি দুর্নীতির পর এ বার নতুন করে সিবিআই তাঁর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্যকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে।
উত্তরপ্রদেশের হাপুড় জেলার গণ্ডগ্রাম ফাগায়ুতা-র এক সাধারণ সরকারি স্কুলশিক্ষকের ঘরে জন্মেছিলেন সিসৌদিয়া। শৈশবে গ্রামেরই সরকারি স্কুলে লেখাপড়া। সেই শৈশব থেকেই মণীশ সরকারি স্কুলের হাল জানেন। পরে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেন। রেডিয়ো জকি, সাংবাদিকের কাজ করতে করতে অল্প বয়সেই সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সাংবাদিকতা করার সময়ই অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, কেজরীওয়ালের তৈরি করা অসরকারি সংস্থা পরিবর্তন-এ যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। সরকারের সঙ্গে জনস্বার্থ নিয়ে লড়াই করা নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করত সংস্থাটি। পরে সাংবাদিকতা ছেড়ে কেজরীওয়ালের সঙ্গে পুরোদমে শুরু করেন ‘কবীর’-এর কাজ। এই সংস্থাটিরও কাজের উদ্দেশ্য ছিল একই। তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত আইনের খসড়াটি যাঁরা তৈরি করেন, সিসৌদিয়া ছিলেন তাঁদের অন্যতম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অণ্ণা হজারের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি ২০১১ সালে। জন লোকপাল বিলের প্রথম সংস্করণটি লেখা এবং আন্দোলনের জন্য প্রথম বার জেলে যাওয়া এর পর।
এ-হেন সিসৌদিয়া ক্রমে দিল্লি সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হলেন। শহরের লাখ লাখ অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের চোখের মণি হয়ে ওঠার পর সেই স্বপ্নের সঙ্গে লোভ মিশে গিয়েছিল কি না, তা আদালতের বিচার্য। আবার তাঁর গ্রেফতারির পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধিও দেখছেন আপ-সহ বিরোধীদের একাংশ। কিন্তু আপাতত ছবি এটাই যে, তাঁর অনুপস্থিতির কারণে বড়ই কোণঠাসা দেখাচ্ছে আপ সরকারকে, যারা কিনা এক সময় সততার সাদা পতাকা উড়িয়ে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তোপ দেগে তখ্তে বসেছিল। মানুষ তাদের নিঃশর্তে বড় ভালবেসে ভোট দিয়েছিলেন বার বার তিন বার।
২০১৩ সালে বিজেপি আপ সরকারকে মাঝপথেই ফেলে দেওয়ার পর দিল্লি নির্বাচনে মণীশ হারিয়েছিলেন বিজেপির নকুল ভরদ্বাজকে। তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের সেই শুরু। এর পর ২০১৫ সালে দিল্লির নির্বাচনে ঝড় তুলল আপ, যার অন্যতম সারথি ছিলেন সিসৌদিয়া। ২০২০ সালের বিধানসভা ভোটে যখন তিনি আপ-এর হয়ে তৃতীয় বারের জন্য জিতে আসেন, তখন দিল্লিতে প্রবল মোদী হাওয়া। সেই জয়ের কৃতিত্ব বহুলাংশে পাওনা সিসৌদিয়ার।কারণ, ২০১৫ থেকে পরের পাঁচ বছরেদিল্লির সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রের ভোল আমূল বদলে দিয়েছিলেন তিনি। যে-হেতু কেজরীওয়াল সরকারের অর্থমন্ত্রীও ছিলেন সিসৌদিয়া, তাই মোট বাজেটের এক-চতুর্থাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি। ভেঙে পড়া পরিকাঠামো, ধুঁকতে থাকা চার পাশের সরকারি স্কুলগুলির পুনর্গঠন, ফুটবল ও হকি মাঠ তৈরি, আধুনিক ক্লাসরুম ও অডিটোরিয়াম, সাঁতারের ব্যবস্থা, নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের সঙ্গে শিক্ষকদের সংযোগ-বৈঠক, প্রত্যেক শিক্ষকের হাতে ছাত্রছাত্রীদের তথ্যসম্বলিত ট্যাবলেট, সামার ক্যাম্প— সবই হয় এই সময়ে। ব্যবস্থা হয় শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের। ছাত্রদের পরিচিত করা হয় বিভিন্ন নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে (যার মধ্যে রয়েছে হ্যাপিনেস কারিকুলামও)। এই সময়েই সফল ভাবে তিনটি রাজ্যস্তরের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছেন সিসৌদিয়া, যেখানে প্রযুক্তি পঠনপাঠনের বিস্তৃত অবকাশ রয়েছে। সাত বছরে সিসৌদিয়ার অর্থমন্ত্রিত্বে দিল্লির বাজেট বেড়েছে ৭ গুণ। উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে কর আদায়ের পরিমাণ। সিসৌদিয়া তৈরি করেছেন ‘আউটকাম বাজেট’, যা সরকারি খরচের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে অনেকটাই সাহায্য করেছে।
এর পরই ক্রমশ ছায়া ঘনাতে থাকে সিসৌদিয়ার ঊর্ধ্বমুখী লেখচিত্রে। ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর নতুন আবগারি নীতি নিয়ে আসে দিল্লি সরকার। বদল আনা হয় মদ কেনাবেচার পদ্ধতিতে। নতুন আবগারি নীতিতে সরকারি মদের দোকানগুলি বন্ধ করে বেসরকারি মদের দোকানগুলিকে মদ বিক্রির অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়। সরকার চেয়েছিল, নতুন করে ৮৪৯টি মদের দোকান খোলা হবে। রাজধানীর ৩২টি অঞ্চলে এই মদের দোকান খোলার পরিকল্পনা ছিল। উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশই ছিলেন আবগারি দফতরের দায়িত্বে। নতুন আবগারি নীতিতে মদের কালোবাজারি বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় বাড়বে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু নতুন নীতি কার্যকর করতে আবগারি লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বিপুল আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে। যার জেরে নতুন আবগারি নীতি চালুর ঠিক আট মাস পর, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দাবি করা হয়, নতুন নীতিতে পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা রয়েছে। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি তথা লেফটেন্যান্ট গভর্নর বিনয়কুমার সাক্সেনা আপ সরকারের এই নতুন নীতিতে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছিলেন।
আবগারি দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় শুরু থেকে শীর্ষে ছিলেন মণীশ সিসৌদিয়া। গত অক্টোবরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ, বাড়িতে তল্লাশির পর নভেম্বরে চার্জশিট জমা করে সিবিআই। অভিযোগ, মিডলম্যান ব্যবহার করে মদ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলিত ভাবে বাড়তি মুনাফা পকেটে ভরার ছক কষেছিলেন সিসৌদিয়ারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy