Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
জানুয়ারি ২০২৩
Shah Rukh Khan

নামভূমিকায়

বিশ্বের দরবারে তিনিই ভারতের ভালবাসার বিগ্রহ। খেলা ঘোরাবেন বলে ‘নতুন ভারত’-এর উগ্র দেশপ্রেমের খেলায় নেমেছেন শাহরুখ খান।

Picture of Bollywood star Shahrukh Khan

শাহরুখ খান। ফাইল ছবি।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০০
Share: Save:

তিন দশক ধরে তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, টোল পড়া হাসি আর প্রসারিত দুই বাহু ভালবাসা বিলিয়েছে অনর্গল। চার বছর পর বড় পর্দায় ফিরে শাহরুখ খান বুঝিয়ে দিলেন, চলতি জমানার বিদ্বেষ-ব্রিগেডকে ক্ষণিকের জন্য হলেও বাঁধ দেওয়ার তাকত তাঁরই আছে। আজও, এখনও। আর ভালবাসা যদি সংক্রামক হয়, তবে তা ঘৃণাকে কমজোরি করে দিতে পারে।

শাহরুখের ভালবাসার এই সফরনামা শুরু হয়েছিল আশির দশকের শেষ দিকে। নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৮৮ সাল। কয়ামত সে কয়ামত তক-এর এই বছরটা তিন খানের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। অভিনেতা হিসেবে নিজের এই দ্বিতীয় ছবিতেই সুপারস্টার হলেন আমির খান। সলমনের প্রথম ছবিও এই বছর— বিবি হো তো অ্যায়সি। পরের বছর (১৯৮৯) ম্যায়নে পেয়ার কিয়া তাঁকেও সুপারস্টার বানাবে। আর, এই বছরই অর্থাৎ ১৯৮৮-তেই দূরদর্শনের পর্দায় আসবেন ক্যাপ্টেন অভিমন্যু— শাহরুখ খানের প্রথম ধারাবাহিক, ফৌজি। ওই ফৌজি থেকেই তাঁর ভালবাসা কেড়ে নেওয়ার শুরু। অভিমন্যুকে ভালবাসেনি এমন টেলিদর্শক তখন ছিল না বললেই চলে। ১৯৮৯-১৯৯০ জুড়ে সেই ভালবাসার রং আরও অনেকখানি গাঢ় হল দুসরা কেবল এবং সার্কাস-কে ঘিরে। ঘরে ঘরে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে মা-মাসিদের বড় আদরের ধন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মাঝারি উচ্চতার ছটফটে সেই ছেলেটি যে অচিরেই বড় পর্দায় তৃতীয় ‘খান’ হতে চলেছেন, তখনও বোঝা যায়নি সেটা। দিওয়ানা মুক্তি পেল ১৯৯২-এ। ছবির দ্বিতীয়ার্ধে বাইক আরোহী শাহরুখ গান গাইতে গাইতে সেই যে ঢুকলেন, বড় পর্দাও তাঁকে ভারী ভালবেসে ফেলল। এমনকি বাজিগর এবং ডর-এ তাঁকে অ্যান্টিহিরোর ভূমিকায় দেখেও সে ভালবাসা ফিকে হল না, উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকল। অতএব এ বার শাহরুখের দিক থেকে ভালবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার পালা।

অতএব ১৯৯৫। দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে। সারা পৃথিবী জুড়ে সেই থেকে আজ অবধি যে শাহরুখ দর্শকের নয়নমণি হয়ে উঠলেন, জনপ্রিয়তম তারকার আসনটি অধিকার করে রইলেন, তিনি ভালবাসার বরপুত্র। বিশ্বের দরবারে তাঁকে দেখিয়ে ভারত যেন বলে উঠল, ‘ফ্রম ইন্ডিয়া, উইথ লাভ’! লন্ডন থেকে বার্লিন, দুবাই থেকে নিউ ইয়র্ক— যান চলাচল স্তব্ধ করে দিতে পারেন যিনি, তিনি শাহরুখ খান। রোম্যান্টিক নায়ক হিন্দি ছবিতে অনেকেই এসেছেন আগে এবং পরে। সফলও হয়েছেন। কিন্তু ছবির পর ছবি জুড়ে ভালবাসার এমনিতর বিস্ফার, এমন উপচে পড়া-ছাপিয়ে যাওয়া-ভাসিয়ে নেওয়া রূপ আর দেখা গিয়েছে কি না সন্দেহ। পাশে কাজল-জুহি-মাধুরী-রানি-প্রীতি-ঐশ্বর্য-দীপিকা-অনুষ্কা যে-ই থাকুন না কেন, শাহরুখের প্রেম উদ্দাম প্লাবনের মতো ধেয়ে গিয়েছে। পর্দায় শাহরুখ যেন ভালবাসার রূপকার মাত্র নন, তিনি স্বয়ং ভালবাসার বিগ্রহ।

এই ভালবাসার ক্ষমতা আর সম্মোহনীশক্তিকে ঝোলায় বেঁধেই আজ আবার রণাঙ্গনে শাহরুখ। বিদ্বেষবিষে জর্জরিত দেশে নিজের তূণীর পরীক্ষা করার এই ছিল তাঁর শেষ সুযোগ। বিগত বেশ কিছু বছর তাঁর সময়টা একেবারে ভাল যায়নি। পর পর ফ্লপ। তার সঙ্গে নাগাড়ে ঘৃণাসেনার আক্রমণ। তিন দশক ধরে অনাবিল আনন্দ দিয়ে আসা এক শিল্পীকে পাকিস্তানের চর, দেশদ্রোহী বলতে তাদের কারও মুখে বাধেনি। মন্নত বাংলো বেচে তোমায় যাতে রাস্তায় নেমে আসতে হয়, সেই ব্যবস্থা করা হবে বলে হুমকি দিতে কারও গলা কাঁপেনি। লতা মঙ্গেশকরের অন্ত্যেষ্টিতে তাঁর দোয়া পড়া নিয়েও অকথ্য প্রচার চালাতে শরমে লাগেনি। শাহরুখ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন, আর নিজেকে ভেঙেচুরে বদলে নিয়েছেন।

স্বদেশ-এর মোহন ভার্গব, চক দে ইন্ডিয়া-র কবীর খানকে আজ সময়ের দাবি মেনে বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার ভার নিতে হয়েছে। উচ্চগ্রামে দেশভক্তির মন্ত্র বলতে হয়েছে। কাশ্মীর, অনুচ্ছেদ ৩৭০, পাকিস্তান ইত্যাদি আমদানি করতে হয়েছে। শাহরুখ ‘নতুন ভারত’-এর এই প্রত্যেকটি ফর্মুলায় জেনেশুনে পা গলিয়েছেন, খেলার নিয়ম মেনে খেলা ঘোরাবেন বলে। তাঁর নিজের যে পঠান পরিচয়ের জন্য তাঁকে বার বার দেশ ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে, তিনি সেই পঠান সত্তাকেই তাঁর অলঙ্কার করে তুলেছেন। বয়কট বাহিনীকে ছারখার করে দিয়ে এক পঠানকে দেশরক্ষক বলে মানতে বাধ্য করেছেন। ৫৭ বছর পার করা এক নায়কের মধ্যে যে এতখানি বারুদ এখনও ঠাসা ছিল, পঠান না ঘটলে কী ভাবেই বা জানা যেত!

এক দিকে অতিমারি, অন্য দিকে দক্ষিণী ছবির প্রকোপ— বলিউডের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল ইদানীং। তার সঙ্গে ছিল বয়কট বাহিনীর দাপাদাপি। কিছু নির্দিষ্ট শিবিরের ছবি ঘিরে শাসকের সমর্থন। সাবেকি বলিউডের ইমারতে আঘাত আসছিল নিরন্তর। পঠানকে ঘিরেও কম বিতর্ক হয়নি। শাহরুখ সবটাই সোজা ব্যাটে খেললেন। প্রচারে বেরোলেন না। মিডিয়াকে ট্যাঁ ফোঁ করার সুযোগ দিলেন না। পর্দায় সলমনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাসতে হাসতে বলে গেলেন, বলিউডকে বাঁচাতে হলে বুড়ো হাড়ের ভেলকিই লাগে। ২০১০-এ শাহরুখের ছক ভাঙার নির্ঘোষ ছিল মাই নেম ইজ খান। ২০২৩-এর পঠান ছকে ঢুকে ছক বদলে দেওয়া বাজিগর। ঘৃণা আর বিভাজনের রক্তবীজকে খোলা ময়দানে ঘাড় ধরে বলে দেওয়া, ভালবাসার তুমি কী জানো?

অন্য বিষয়গুলি:

Shah Rukh Khan Bollywood Actor Superstar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy