Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Gyanvapi Mosque

Hindu Muslim relationship: জ্ঞানবাপীর পর আবারও মনে হচ্ছে, সমাজে মানুষ কই! দিন দিন বাড়ছে হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা

একদিকে কাটরা মসজিদের বয়স হল ৫০০ বছর। অন্য দিকে, দেশ জুড়ে জ্ঞানবাপী এবং কুতুব মিনার বিতর্ক। দুই বিষয়ের প্রেক্ষাপটে সমাজকে দেখা প্রয়োজন।

বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল ঠিক তিরিশ বছর আগে।

বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল ঠিক তিরিশ বছর আগে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নীহারুল ইসলাম
নীহারুল ইসলাম
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২২ ১৪:৩৩
Share: Save:

বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল ঠিক তিরিশ বছর আগে। তার পর দেশ জুড়ে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। মনে হয়েছিল, এ বার বুঝি আমরা হিন্দু-মুসলমান ছেড়ে বেরিয়ে এসে মানুষ হব। কিন্তু না! সে সব মনে হয় অলীক ভাবনা। সম্প্রতি জ্ঞানবাপী মসজিদ ও কুতুব মিনার নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে মনে পড়ল মুর্শিদাবাদ স্টেশনের সেই বৃদ্ধকে, যিনি সেই কবে বলেছিলেন, ‘‘মানুষ! মানুষ আর কুন্ঠে (কোথায়) পাবেন? এই দুনিয়ায় কি আর মানুষ আছে! আমরা তো সব হিন্দু আর মুসলমান।’’

১৯৮৬ সাল। আমার তখন উচ্চমাধ্যমিক। হঠাৎ শুনলাম, কাটরা মসজিদে জুম্মার নমাজ পড়তে যাবে বলে একদল মানুষ হুজুগ তুলেছে। তাদের প্রশ্ন, কাটরা মসজিদ সংলগ্ন শিবমন্দিরে হিন্দুরা যদি পুজো করতে পারে, তা হলে মুসলমানদের ওই মসজিদে নমাজ পড়তে বাধা কোথায়? সাধারণ ভাবে শুনলে মনে হবে যুক্তির কথা। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, কাটরা মসজিদে নমাজ পড়তে যাওয়াটা ছিল একটা হুজুগ। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার মতো একটা ব্যাপার।

জ্ঞানবাপী মসজিদ।

জ্ঞানবাপী মসজিদ। —ফাইল চিত্র।

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তি বলছে, ১৭২৩ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ কাটরা মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন ১৯.৫ একর জমির উপর। এই মসজিদে একসঙ্গে ৭০০ জনের কোরান পাঠ এবং ২,০০০ লোকের নমাজ পড়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেটা তো অতীত! বর্তমানে সে সব কিছু নেই। আছে বলতে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধির উপর তাঁর তৈরি কাটরা মসজিদের কঙ্কাল।জন্ম থেকে সেটাই দেখে আসছিলাম। তা হলে ১৯৮৬ সালে সেখানে নমাজ পড়ার হুজুগ তুলল কারা? খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। পরিণতির কথা ভাবছিলাম। তার মধ্যেই ঘটে গেল নশিপুর রেল স্টেশনে একটা যাত্রিবাহী ট্রেন আটকে যাত্রীদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ। কেউ বললেন, সেটা ছিল কাটরা মসজিদে মুসলমানদের নমাজ পড়তে যাওয়ার বদলা। কেউ বললেন, দাঙ্গা। আমি বুঝেছিলাম, ওটা ছিল পরিকল্পিত গণহত্যা। কিছু বর্বর লোকজন ভাড়াটিয়া খুনিদের সাহায্যে ঘটিয়েছিল ওই ঘটনা। কেন না ওই ট্রেনে শুধু মুসলমান যাত্রী ছিলেন না। হিন্দুরাও ছিলেন। আজও তাঁদের অনেকের কোনও খবর নেই। আমার ব্যক্তিজীবনে সেটা ছিল প্রথম দমবন্ধ করা অবস্থা। ক’দিন চাপা উত্তেজনার মধ্যে কী ভাবে রাত-দিন কেটেছিল, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব করা নয়।

এর অনেক পরে এক জন বিখ্যাত তথ্যপরিচালকের সঙ্গে তাঁর একটি তথ্যচিত্র শ্যুট করতে গিয়েছিলাম মুর্শিদাবাদের রানিনগর ব্লকে। আমার নাম ‘নীহারুল’। কিন্তু লোকে ডাকে ‘নীহার’ বলে। নীহার হিন্দু না মুসলমান, কে অত ভাবে? স্বভাবতই আমি ঢুকতে পেরেছিলাম এক ভদ্রলোকের বাড়ির অন্দরমহলে। বন্ধুদের সঙ্গে যেমন ঢুকেছি অনেক মন্দিরের গর্ভগৃহে। এখানে সেই গল্প থাক। শুধু বলি রানিনগরের সেই ভদ্রলোকের বাড়ির কথা। সে দিন ভদ্রলোকের বাড়িতে নামকীর্তনের আসর বসেছিল। সবার সঙ্গে আমিও তৃপ্তি করে ভোগ খেয়েছিলাম। তথ্যচিত্রের প্রয়োজনে ওই ভদ্রলোককে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম! তাঁর সার কথা— মুসলমানের বাড়বাড়ন্ত মানেই হিন্দুর সংহার। হিন্দুর ধনসম্পদ, হিন্দুর বাড়ি-ঘর, হিন্দুর মা-বোনের ইজ্জত, কোনও কিছুই বাঁচানো যাবে না।

কুতুব মিনার।

কুতুব মিনার। —ফাইল চিত্র।

খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম কথাটা শুনে। আমি যে সমাজে বাস করি, সেখানেও তো অনেক হিন্দু। আমরা পাশাপাশি বাস করি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা একে অপরের পাশে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছি যুগ-যুগ ধরে। তা হলে এই ভদ্রলোক এ কী বলছেন! এত রাগ! এত বিদ্বেষ! কোথা থেকে আসে?

যেমন আশ্চর্য হয়েছিলাম আমার এক মুসলমান বন্ধুর কথা শুনে। গুজরাত দাঙ্গার সময় একতরফা মুসলমান নিধনের খবর শুনে সে বলেছিল, ‘‘আমাদেরও উচিত এখানকার হিন্দুদের নিধন করা। তা হলে ওরা শিখবে।’’

পরে ধীরে ধীরে টের পেয়েছি, এ সব আসলে নিয়মিত চর্চা হয়। সেই চর্চার জন্য হরেক রকম সংগঠন রয়েছে আমাদের চারপাশে। যারা পালে হাওয়া পেয়ে কিংবা হাওয়া লাগিয়ে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে আমাদের সমাজে, আমাদের মনে। এর ফলে রানিনগরের ওই ‘হিন্দু’ ভদ্রলোক কিংবা আমার সেই ‘মুসলমান’ বন্ধুর মতো আমাদের সমাজে মানুষ নয়, হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর থেকে মুক্তির পথ খুঁজছি। পাচ্ছি না। শুধু অন্ধকারে আঁচড় কাটছি।

১৯৮৬ সাল। কাটরার ওই ঘটনার কিছু দিন পর মুর্শিদাবাদ শহরে গিয়েছিলাম কোনও কাজে। ফিরব দুপুরের ট্রেনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। আশপাশে বহু মানুষ। কিন্তু কারও মুখে উচ্চস্বরে কোনও কথা নেই। তার মধ্যেই হঠাৎ শুনি কেউ গলা ছেড়ে বলছেন, ‘‘মানুষ আর কুন্ঠে গো?’’

চার পাশে তাকিয়ে দেখি, কোথাও দু’জন, কোথাও তিন জন— ছোট ছোট দলে অনেকে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তবে ফিসফিস করে। তাঁদের মধ্যেই এক জন প্ল্যাটফর্ম আঁকড়ে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছেন। বিড়ি টানতে টানতে তিনি আবার গলা ছেড়ে বলে উঠলেন, ‘‘মানুষ! মানুষ আর কুন্ঠে পাবেন? এই দুনিয়ায় কি আর মানুষ আছে?’’

এক জন চাষাভুষো মানুষের এই কথায় কেউ আগ্রহ দেখাননি। আমি কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘আমরা তা হলে কে?’’বৃদ্ধ মুখের বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমরা তো সব হিন্দু আর মুসলমান!’’

(লেখক লালগোলার একটি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষা সম্প্রসারক। মতামত নিজস্ব।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Gyanvapi Mosque hindu Muslim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy