শ্রীরামপুর কলেজের দরজার নোটিস টাঙিয়েছে পুলিশ। নিজস্ব চিত্র
মাথা না থাকিলে সাধারণত মাথাব্যথাও থাকে না। জয়পুরিয়া কলেজের ছাত্ররা ক্লাস না করুক, লেখাপড়ায় মন না দিক, বুদ্ধিতে খাটো নহে। ফলে, মাথাব্যথার উপশম হিসাবে তাহারা মাথাটিকেই গায়েব করিয়া ফেলিল। ক্লাসে ৬০ শতাংশেরও কম হাজিরা, অতএব হাজিরা খাতা লুট করিয়া লইয়া গেল। শেষ অবধি অবশ্য লঘুক্রিয়া হইয়া গিয়াছে। কলেজের গেটের বাহিরে সেই খাতা পাওয়া গিয়াছে। সিসিটিভি ক্যামেরায় তাহাদের ছবি উঠিল, দুই জনের হাতে কারণ দর্শাইবার নোটিসও ধরাইয়া দিয়াছেন অধ্যক্ষ। খেলা কি তবে ফুরাইল? দস্যি ছেলে লক্ষ্মী হইল? সেই দিল্লি দূর অস্ত্। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে যাহারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলিয়া জ্ঞান করিতে অভ্যস্ত— সেই সংস্কৃতিতেই বড় হইয়াছে, কলেজে ঢুকিয়া সেই সংস্কৃতিই পাইয়াছে— শিক্ষামন্ত্রীর এক দিন গোসা হইলেই সেই ছাত্ররা সব শুধরাইয়া যাইবে, এমনটা সম্ভবত সত্যযুগেও হইত না। যে ছাত্ররা জানে যে কলেজে ক্লাস করিবার প্রয়োজন নাই, উপস্থিতির হার লইয়া প্রশ্ন উঠিলে কোনও ‘দাদা’ অথবা ‘দিদি’ আসিয়া সামলাইয়া দিবেন, তাহারা এত সহজে পথে ফিরিবে বলিয়া আশা করা মুশকিল। আশঙ্কা হয়, সংবাদমাধ্যমে হইচই থামিলে কলেজ অধ্যক্ষের রাগও পড়িয়া যাইবে। অভিযুক্ত ছাত্রদের বহিষ্কার করিবার হুমকিটিও হাওয়ায় মিলাইবে। সাধারণ হাওয়া নহে, রাজনীতির হাওয়া। কলেজে-কলেজে দাপাইয়া বেড়াইবার দুঃসাহস ছাত্রদের অকারণে হয় নাই। পিছনে রাজনীতির খুঁটি আছে বলিয়াই তাহারা বেপরোয়া। বস্তুত, যে কারণে এই রাজ্যে অটোচালকরা দুর্বিনীত, ছাত্ররাও ঠিক সেই কারণেই কলার তুলিয়া ঘোরে। প্রত্যেকেই রাজনীতির সন্তান। আরও স্পষ্ট করিয়া বলিলে, রাজনীতির নামে যে ক্লায়েন্টেলিজ়ম চলিতেছে, তাহার গর্ভেই পশ্চিমবঙ্গের সমাজের জন্ম।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ‘বহিরাগত দাদা’দের দাপট লইয়া শিক্ষামন্ত্রী অসন্তোষ জানাইয়াছেন। এই দাদারাও মঙ্গলগ্রহ হইতে নামিয়া আসে নাই। তাহারাও বঙ্গীয় রাজনীতিরই সন্তান। এবং, রাজ্যের আর সব অবক্ষয়ের ন্যায় ইহাও বাম জমানার উত্তরাধিকার। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখিবার কাজে এই দাদারা গুরুত্বপূর্ণ। ক্লায়েন্টেলিজ়মের ধর্মই হইল, আনুগত্যের বিনিময়ে কিছু পাওয়াইয়া দিতে হয়। দাদারা ক্লাস না করিবার স্বাধীনতার বিনিময়ে আনুগত্য কিনিয়াছে। ছাত্ররা যথেচ্ছাচারের অধিকার পাইয়া অনুগত হইয়াছে। মন্ত্রিবর অসন্তুষ্ট হউন, কলেজের অধ্যক্ষ চটিয়া যাউন, কিন্তু এই দাদাকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করিতে হইলে আঘাত করিতে হইবে অন্যত্র— সমাজে সর্বময় আধিপত্য বিস্তারের রাজনৈতিক বাসনার মূলে। সেই ঝুঁকিটি তাঁহারা লইতে পারিবেন কি? তাঁহারা বরং অন্য দিকে তাকান। যে ছাত্ররা দিনের পর দিন ক্লাসে যায় না, তাহাদের প্রশ্ন করুন, কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন কী? রাজ্যের আজ সেই অবস্থা নাই যে কলেজের ডিগ্রি থাকিলেই চাকুরি জুটিবে। পিএইচ ডি ডিগ্রিধারীরা চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর পদের জন্য আবেদন করিতেছেন, এমন সংবাদ পশ্চিমবঙ্গে বিরল নহে। রাজনীতির কল্যাণে শিক্ষার আর সেই মাহাত্ম্যও নাই যে তাহাতে সামাজিক সম্মান বাড়িবে। তবে আর কলেজে ভর্তি হওয়া কেন? রোজগারের অন্য পথ বিলক্ষণ আছে— দুর্জনে বলে, পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের বৃহত্তম পরিসর রাজনীতি। সিন্ডিকেটও স্বমহিমায় আছে বলিয়াই খবর। সেই দিকে মন দিলে হয় না? উচ্চশিক্ষা শুধু তাহাদের জন্যই, যাহারা শিক্ষার মর্ম বোঝে। যাহারা জ্ঞান অর্জন করিতে ক্লাসে যায়, অ্যাটেনডেন্সের টানে নহে। ৭৫ শতাংশ নহে, কোনও অকাট্য কারণ না থাকিলে প্রতিটি ছাত্রের ক্লাসে ১০০ শতাংশ হাজিরা থাকা বিধেয়। শিক্ষাকে এই গুরুত্ব দিতে যাহারা নারাজ, তাহাদের জন্য অন্য রাস্তা আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy