Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
Usha Ganguly

বেদনার সঙ্গে জীবনও ফুটে উঠত তাঁর অভিনয়ের মঞ্চে

কোথায় যেন দেখেছিলেন এক মহিলা ভ্যানচালককে। খোঁজ নিয়ে জানলেন, সংসার চলে তাঁরই রোজগারে। সেই ভ্যানচালকের জীবনই পরে তিনি থিয়েটারের ভাষায় তুলে ধরলেন মঞ্চে। লিখছেন বিপ্লব দেছোট বয়স থেকেই সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে সাত বছর বয়সে নৃত্যশিক্ষার সূচনা এবং কলেজ জীবন পর্যন্ত সেই অনুশীলন করে যাওয়া।

ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়।

ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৫১
Share: Save:

পর্দা জুড়ে বিশ্ব জুড়ে বিপর্যয়ের মুখে আরও একটি দুঃসংবাদ নেমে এল। প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট নাট্যজন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। সব নাট্যকর্মীদের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন তিনি। বহরমপুরের ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠীও তার বাইরে ছিল না। সাহচর্য ও নাট্য শিক্ষাদানে তাঁকে যখনই আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তখনই সময় দিয়েছেন। মনে পড়ছে ১৯৯৭ সালে পুরনো ঋত্বিকের ঘরে আমরা শিক্ষার্থীরা গোল হয়ে বসে দু’দিন ধরে অভিনয় শিক্ষার পাঠ নিয়েছি। তাঁর নির্মিত নাটক ‘লোককথা’, ‘মহাভোজ’-এর উদাহরণ দিয়ে অভিনয়ের মাত্রাগুলোবুঝিয়ে দিয়েছেন।

রঙ্গকর্মীর প্রযোজনা হিন্দি হলেও বাংলা নাট্যমহলে তাঁর প্রযোজনাগুলি বাংলাভাষী দর্শকের কাছে সমান ভাবেই গৃহীত হয়েছে। ছোট বয়স থেকেই সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে সাত বছর বয়সে নৃত্যশিক্ষার সূচনা এবং কলেজ জীবন পর্যন্ত সেই অনুশীলন করে যাওয়া, তাঁর অভিনয় জীবন সমৃদ্ধ করেছিল। প্রথম জীবনে সঙ্গীত-নৃত্যশিল্পী হিসেবেই মঞ্চে অবতরণ করেন। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে বসন্তসেনার চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তখনও রঙ্গকর্মী তৈরি হয়নি। পরবর্তীতে ‘পদাতিক’-এ শ্যামানন্দ জালানের সান্নিধ্যে এসে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজের পরিচিতি এবং ১৯৭৬ সালে তিনি রঙ্গকর্মী নাট্যদল গঠন করেন। মূলত হিন্দি নাটক করবার প্রয়াস নিয়েই দল গঠন। আমার দেখা তাঁর বাংলা নাটক ‘মুক্তি’। জনপ্রিয় অভিনেত্রী কেতকী দত্তের সেরা অভিনয়কে বহু বছর পরে মঞ্চে তুলে ধরার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় সেই অভিনেত্রী যিনি বহু কৃতী নাট্য নির্দেশকের অধীনে কাজ করেছিলেন। শ্যামানন্দ জ্বালান, এম কে রায়না, অনুরাধা কাপুর, তৃপ্তি মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী ইত্যাদি। তাঁর লোককথা, মহাভোজ, বদনাম মান্টো, কোর্ট মার্শাল-এর মতো প্রযোজনা সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে।

মাঝে মাঝে প্রকৃত জীবনের সন্ধানে তিনি মগ্ন হয়ে পড়তেন। জীবনের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সেই জীবনকেই মঞ্চে ধরার চেষ্টা করেছেন। কোথায় যেন নাট্য প্রযোজনা নিয়ে যেতে গিয়ে দেখেছিলেন, এক মহিলা ভ্যানচালককে। খোঁজ নিয়ে জানলেন সংসারে আয়ের তিনিই প্রধান কর্তা। সেই অজ পাড়া গাঁ থেকে ভ্যানচালিকাকে নগরের মঞ্চে এনে থিয়েটারের ভাষায় তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন সেই সব সমাজ এবং প্রান্তিক মেয়ে জহুরা বেওয়ার কথা।

অধ্যাপনার পাশাপাশি সমাজের বহু বিচিত্র ঘটনাকে নাট্যদর্শকের কাছে অনায়াস শিল্পমহিমায় তুলে ধরেছেন। লোককথা নাটকের সাবিত্রী, গুড়িয়া কা ঘর নাটকে মুনিয়া, আন্ধের নগরীতে আনাজ বিক্রেতার চরিত্রায়নের মধ্যে দিয়ে আমরা সময়কে দেখেছি এবং চিনেছি যথার্থ রূপে। প্রগতিশীল বাম আন্দোলনে তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তাই তিনি নাট্য প্রযোজনাগুলোকে কী ভাবে দর্শকের কাছে পৌঁছনো যায়, সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। উৎপল দত্তের ভাষায় স্লোগানও আর্ট হয়ে উঠত। সাম্প্রতিক ঘটনাকে সঙ্গী করে ছোট ছোট পরিসরে খণ্ডচিত্রে তাঁর অঙ্গন নাটকগুলোও ছিল প্রশংসনীয়।

শুধু কলকাতা নয়। এ বাংলার কোণে কোণে নিয়মিত নাট্যচর্চায় রত নাট্যদলের কাছে তিনি ছিলেন পরম প্রিয়জন। দেখা হলেই জানতে চাইতেন ঋত্বিক কী করছে, যুগাগ্নি কী করছে? বহরমপুর রঙ্গাশ্রমের খবর কী? দু’হাজার সালের গোড়ার দিকে ‘বহিরঙ্গন’ নামে একটি অঙ্গন নাটকের ফোরাম তৈরি হয়েছিল। সেখানে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা দেখেছি। যাঁরা এই ধরনের বিকল্প নাটক নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের সেই ফোরামে এনে নাট্যচর্চার বিস্তার এবং কী কী উপায়ে তার প্রসার হতে পারে তার কথা ভেবে যেতেন নিরন্তর।

কর্মশালা ভিত্তিক নাট্যনির্মাণে তিনি ছিলেন বেশি উৎসাহী। তিনি নিজে নৃত্যশিল্পী হওয়াতে তাঁর নির্মিত প্রযোজনাগুলি আকর্ষণীয় চিত্রসহযোগে মঞ্চে প্রতিফলিত হত। মাইয়াত, ইন্সপেক্টর মাতাদিন চাঁদপর, কাশীনামা নাটকে দেখেছি ছন্দ এবং কোরিওগ্রাফের মধ্যে দিয়ে দর্শককে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করাচ্ছেন। বেদনা, হতাশা, ক্লান্তি সবটাই যেন ধরা আছে সেই সব প্রযোজনার চলনে। গভীর নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা এবং নিয়মিত চর্চার মধ্যে দিয়ে রঙ্গকর্মী নাট্যদলকে বাংলার নাট্য আন্দোলনে প্রথম সারিতে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথাগত কাজ করার পরিবর্তে বিকল্প স্পেস এবং ভাবনা নিয়ে কাজ করার দিকে মনোনিবেশ করতেন তিনি। ‘বিনোদিনী কেয়া’ স্টুডিও মঞ্চ তারই ফসল।

থিয়েটারের যে কোনও কর্মশালায় তিনি বলতেন ‘‘জীবনে চলার পথে অনেক প্রতিকূলতা আসবে। নিজেকে শক্ত হয়েই এগোতে হয়। কিন্তু সেখান থেকেই সহজ রসকেও বের করে আনবার চেষ্টা করতে হবে।’’ সব স্পেসে কাজ করার পক্ষে তিনি মত দিতেন যাতে অভিনেতা অভিনেত্রীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট নারীচরিত্র নিয়ে তাঁর ভিন্ন মাত্রায় গড়ে ওঠা ‘মানসী’ প্রযোজনা বাঙালি দর্শককে আপ্লুত করেছে।

নাটকের সূত্রে বহু দেশ ঘোরা এবং বহু নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে কাজ করার অভিজ্ঞতায় বাংলা থিয়েটারে তাঁর আলাদা পরিচিতি ছিল। ১৯৯৮ সালে থিয়েটারে অবদানের জন্য তাকে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয়।

৭৫ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণে বাংলা তথা ভারতের থিয়েটার হারাল এক নাট্যচিন্তককে। থিয়েটার অঙ্গনে কাজ করার সুবাদে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ও ‘ঋত্বিক’ তার কাছে বহু বিষয়ে ঋণী। দেখা হলেই বলতেন ‘‘বহরমপুরে একটা জাতীয় পর্যায়ের কর্মশালা করো আমি সাহায্য করব। তোমরাই পারবে তোমাদের সাংগঠনিক দক্ষতায় পরিচালিত করতে।’’ সাহস করে এগোতে পারিনি। কাজের স্বীকৃতি এবং পরিচয়েই বেঁচে থাকবেন তিনি। বহরমপুরের নাট্যমহলে তাঁর আলাদা গ্রহণযোগ্যতা ছিল।

ঋত্বিকের আমন্ত্রণে দেশবিদেশের নাট্যমেলায় তাঁর ‘কাশীনামা’, ‘মাইয়াত’, ‘মুক্তি’, ‘জহুরা বেওয়া’, ‘কোর্ট মার্শাল’ বহরমপুরে
প্রযোজিত হয়েছে।

তাঁর জীবন নির্ভর একসংলাপী নাটক ‘অন্তর্যাত্রা’ নির্মাণ করেই আমাদের বলেছিলেন ‘এটি বহরমপুরে করতে চাই।’ দাবি এবং ভরসা রেখে নতুন কাজ করে ঋত্বিককে জানাতেন। এসেছিল সে প্রযোজনা বহরমপুরে। তখন ঋত্বিকের অন্যতম পরিচালক গৌতম রায়চৌধুরী বেঁচে ছিলেন। গৌতমদা ঊষাদির কাছ থেকে ঠিক দিশা এবং সাহায্য প্রত্যাশা করেছিলেন। ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন অকৃপণ। আমাদের ‘শাহাজাদির গল্প’ এবং ‘জতুগৃহ’ তাঁর সাহায্য অনুসরণ করেই নির্মাণ।

বেঁচে থাকুক তাঁর স্বপ্নের রঙ্গকর্মী ও বিনোদিনী কেয়া স্টুডিও থিয়েটার। ১৯৭২ সাল থেকে আজ অবধি প্রায় ৪৮ বছর নিরলস নাট্যকর্মে নিবেদিত ছিলেন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। গত বছরেও দেখেছি তাঁর ৭৪ বছর বয়সে স্টুডিও থিয়েটারে দাপটের সঙ্গে ক্লাস নিতে এবং নবীনদের স্বপ্ন দেখাতে। উত্তর প্রজন্মের আগামী কাজ দিয়েই ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে
থাকবেন চিরকাল।

অন্য বিষয়গুলি:

Usha Ganguly Drama Hindi Drama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy