অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার দুফলো এবং মাইকেল ক্রেমার। ফাইল চিত্র
১০ ডিসেম্বর। স্টকহল্মের কনসার্ট হলে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘নোবেল’ পুরস্কার তুলে দেওয়া হল অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর স্ত্রী এস্থার দুফলো এবং মাইকেল ক্রেমারের হাতে। দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে গবেষণায় তাঁদের মডেলটি অভিনব। গবেষণাগারে নয়, বরং বাইরে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে দারিদ্রের মূল কারণ কী, তা আরও গভীর ভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে তাঁদের গবেষণা— নোবেল কমিটির তরফে এ ভাবেই তাঁদের কাজকে বর্ণনা করা হয়েছে।
দারিদ্র মানুষের একটি মৌলিক সমস্যা। উন্নয়নের অর্থনীতিতে দারিদ্রের পরিমাপ যেমন প্রয়োজন, তার থেকে বেশি দরকার তার দূরীকরণ। বিভিন্ন দেশে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার তরফে দারিদ্র দূরীকরণে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হলেও দারিদ্রের থাবা প্রসারিতই হচ্ছে। উন্নয়নের জোয়ার এলেও সেখানে গরিব মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এঁদের গবেষণা এক নতুন দিকের সূচনা করেছে। উন্নয়নের প্রশ্নে দারিদ্র ও দরিদ্র মানুষের বিষয়কে গুরুত্বদান এবং দারিদ্র দূরীকরণে নেওয়া প্রকল্পগুলি আদৌ সফল হবে কি না, তারই পূর্বাভাস দিতে চেয়েছেন অভিজিৎ-এস্থার-মাইকেল ত্রয়ী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে কল্যাণকর অর্থনীতির সূচনা হয়েছিল। ভারতে মোটামুটি ভাবে আশির দশক পর্যন্ত তা কার্যকরী ছিল। পরবর্তীতে উন্নয়নের অর্থনীতিতে ‘চুঁইয়ে পড়া’ তত্ত্বের আবির্ভাব হয়, যার মর্মার্থ ছিল দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার সুনিশ্চিত করা। এতে বিত্তবানেরা লাভবান হলেও আর্থিক বৃদ্ধির ফল চুঁইয়ে সমাজের নীচের স্তরেও নেমে আসবে, যাতে লাভবান হবে আপামর জনগণ। সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারতেও এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তৈরি হয়েছে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যও। তাই, এই তত্ত্ব এক বিরাট তামাশা ছাড়া কিছু নয়। কারণ, যাঁরা এই তত্ত্বের প্রবক্তা, তাঁরা বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, দারিদ্র দূর করতে কোনও সরকারি প্রকল্প গ্রহণের অর্থ হল মানুষকে অলস করে দেওয়া। তাই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারের দিকেই নজর দেওয়া উচিত। কিন্তু সেই নীতি গ্রহণে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে ধনী আরও ধনী আর গরিব আরও গরিব হয়েছে। ২০১৯ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারত দাঁড়িয়ে ১০২-এ।
অভিজিৎ ও এস্থার ওই পথে না হেঁটে দারিদ্র দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পগুলিকে নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন। ২০০৩ সালে তাঁরা ‘আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাবরেটরি’ তৈরি করেন, যেখান থেকে বিশ্বের ১৮টি দেশে ৩৫০টিরও বেশি পরীক্ষা চালানো হয়েছে। যে পদ্ধতিটি তাঁরা অনুসরণ করেছেন, তা হল ‘র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ বা সংক্ষেপে ‘আরসিটি’। ২০১১-এ প্রকাশিত তাঁদের বই ‘পুওর ইকনমিক্স’-এর পাতায় চোখ বোলালে বোঝা যায়, তাঁদের গবেষণার সারবস্তুগুলি। দেখা যায়, কী ভাবে দু’দল গরিব মানুষের এক দলের মশারি ব্যবহার আর অন্য দলের তা না ব্যবহারের ফলে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যার অনেকটাই ফারাক ঘটেছে। বিশেষত, যে সব মানুষের মাথাপিছু দৈনিক গড় আয় ১ ডলারেরও কম, তাঁদের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়েছে। রাশিবিজ্ঞানের নিয়মেই তাঁরা দেখিয়েছেন, পুষ্টি, শিশুর টিকাকরণ বা শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোন কর্মসূচিটি সফল ভাবে কার্যকরী হতে পারে বা কোনটি অসফল হবে।
এটা অনস্বীকার্য যে, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গবেষণাগার দরিদ্র মানুষের শিকড় অনুসন্ধান করেছেন। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের ভূমি সংস্কার-সংক্রান্ত বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় দেখিয়েছেন যে, ভূমি সংস্কারে কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে। মাইকেল ক্রেমার কাজ করেছেন কেনিয়ায়। এঁরা এই সব হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাঁদের বুঝতে ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব হাতেকলমে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। দেখিয়েছেন, একই ধরনের প্রকল্প সর্বত্র সর্বজনীন ভাবে ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। তাই, এলাকা, সময় ও অন্য ভৌগোলিক, সামাজিক অবস্থান বিচার করে প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গবেষণায় কাজে লাগানো ‘র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ বা ‘আরসিটি’ পদ্ধতি সাধারণত চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে কোনও নতুন ওষুধের কার্যকারিতা দু’ভাবে পরীক্ষা করা হয়। তাই এই পদ্ধতি অর্থনীতির মতো সমাজবিজ্ঞানে প্রয়োগ ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। প্রকৃতি বিজ্ঞানে সর্বজনীন যে সত্য, যেমন একটি আপেল পড়া থেকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রমাণ সম্ভব, তা মানুষের আচরণ-সংক্রান্ত তত্ত্বে কী ভাবে সম্ভব? অনেকেই এখানে বলার চেষ্টা করছেন, ২০১৫ সালে অর্থনীতিতে নোবেল প্রাপক অ্যাঙ্গাস ডিটনের যে গবেষণা, তার অভিমুখ ছিল দারিদ্র, ভোগ এবং কল্যাণকর অর্থনীতি এবং তার পদ্ধতিও ছিল বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ-নির্ভর বিশ্লেষণ।
কোনও কোনও সমালোচকের মতে, ‘আরসিটি’ যেহেতু স্থান-কাল-পাত্রনির্ভর ও ক্ষুদ্র পরিসরভিত্তিক, তাই এর ভিত্তিতে সামগ্রিক ভাবে উন্নয়নের নীতি প্রয়োগ আদৌ সম্ভব নয়। অভিজিৎ-এস্থার-মাইকেলের কাজ গবেষণালব্ধ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল এবং বহু ‘কেস স্টাডি’ ও তার ফলাফলে বর্ণিত, যা থেকে বোঝা মুশকিল যে গরিবকে দারিদ্রসীমার উপরে তুলতে কখন ‘আরসিটি’ কাজ করবে আর কখন করবে না। এই তত্ত্বে যাঁরা খুব গরিব, তাঁদেরকেই ক্ষুদ্র স্তরে আরও একটু ভাল করে রাখার কথা ভাবা হয়েছে।
এ সব সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, নোবেল কমিটি এ বারে অর্থনীতিতে তথাকথিত তাত্ত্বিক মডেল বাদ দিয়ে তিন জন ব্যতিক্রমীকে পুরস্কার দিয়েছেন। শুধু সাহায্য করে বা কিছু পাইয়ে দিয়ে সামগ্রিক ভাবে দারিদ্র দূর করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন, সর্বতো ভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন। সে দিকে দৃষ্টিপাত করা না হলেও এই গবেষণা প্রথাগত নীতিগ্রহণ ও চিন্তার জগতে আলোড়ন তৈরি করেছে। বিশ্বের নানা দেশ ঘুরে ঘুরে গরিব মানুষের জীবনকে বিভিন্ন ভাবে বুঝে যে কাজ তাঁরা করেছেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ এই নোবেলপ্রাপ্তিকে নতুন দিকের সূচনা অবশ্যই বলা যায়।
লেখক অর্থনীতির শিক্ষক, বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy