Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
আত্মঘাতের ঘণ্টা
Refugee

আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনে ঘরোয়া রাজনীতির ঘোর কালো ছায়া

Histতাকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলুম, এত কষ্ট, এত লাঞ্ছনা সহ্য করে সে আমেরিকায় পড়তে এল কেন? সে একটু হেসে তার বাবার কথা বলেছিল।

অনিকেত দে
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২০ ০০:৫৩
Share: Save:

তখন আমেরিকা ২০০৮ সালের মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বারাক ওবামা আফগানিস্তানে গিয়ে যুদ্ধ শেষ করার লক্ষ্যে সই করেছেন, আর স্কলারশিপ নিয়ে সে দেশের কলেজে গিয়েছি আমি আর আবুজ়ার। আবুজ়ারের বাড়ি গজ়নি শহরে। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে সেই নাম শুধু সুলতান মামুদের গল্পে আর মুজতবা আলীর বইয়ে পড়েছি। অবশ্য যুদ্ধ শুরু হতে তারা পুরো পরিবার পাকিস্তানের পেশোয়ারে পালিয়ে আসে, ছোটবেলাটা তার সেখানেই কাটে। আমি আমেরিকায় আসার জন্যে স্যাট পরীক্ষা দিয়েছিলুম বাড়ি থেকে বাসে চৌরঙ্গিতে আমেরিকান সেন্টারে গিয়ে। আর আবুজ়ার টাকা ধার করে কাবুল থেকে ভারতের ভিসা নিয়ে দিল্লি এসে পরীক্ষা দিয়েছিল। সেই সময় কাবুলে পরীক্ষা হত না। আর দশটা বিদেশি ছাত্রের মতো আমি পাঁচ বছর থাকার ভিসা পাই, আবুজ়ার পায় তিন মাসের। বুশ আমল থেকেই কোনও এক আশ্চর্য যুক্তিতে ছাত্রদের ভিসা নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকার বর্ডার পুলিশের একটি বিভাগ, যারা আফগানদের বিশেষ সন্দেহের চোখে দেখত। সেই সন্দেহ আবুজ়ারের জীবনে এমন জড়িয়ে গিয়েছিল যে এক বার দেখি রাত ন’টার বিমান ধরতে সকাল দশটায় বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। এত তাড়া কেন জিজ্ঞেস করতে অবাক হয়ে বলল, ‘‘ও মা, বিমানবন্দরে তো আমাকে জেরা করতেই পাঁচ-ছ’ঘণ্টা লাগে। তোমাকে করে না?’’

তাকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলুম, এত কষ্ট, এত লাঞ্ছনা সহ্য করে সে আমেরিকায় পড়তে এল কেন? সে একটু হেসে তার বাবার কথা বলেছিল। রিফিউজি হয়ে প্রবাসে থাকার সময় তার বাবা পেশোয়ারে একটি মেয়েদের স্কুল খোলেন, যুদ্ধের পর কাবুলের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে স্কুল সেখানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। শিক্ষার মূল্য তার দেশের লোক জীবন দিয়ে বুঝেছে। আমেরিকান সেনার ওপর যেমন তার কোনও ভক্তি নেই, তেমনই সেখানকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শ্রদ্ধার অন্ত নেই। আবুজ়ার একের পর এক যুদ্ধোত্তর দেশ-বিষয়ক ক্লাস করে চলে। ভিয়েতনাম, রোয়ান্ডা, কসোভো, ইরাক— শিখতে চায় কী ভাবে একটা দেশ যুদ্ধের পর ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তালিবান-শাসনে বড় হওয়া ছেলেটি বার বার বলে যে শিক্ষাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা আমেরিকার সর্বোত্তম কৃতিত্ব। যে দিন শিক্ষার ওপর এই দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করবে, বুঝতে হবে এই দেশের অবক্ষয় শুরু হয়েছে।

গত সপ্তাহে শুধুমাত্র-অনলাইন কলেজগুলির বিদেশি ছাত্রদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ নিয়ে বর্ডার পুলিশের নির্দেশিকা হাতে পেয়ে তার সাবধানবাণীটি মনে পড়ল। এ বার একেবারে কলেজগুলোর ওপর যুদ্ধ ঘোষণা: যেন তারা দেশের শত্রু হয়ে গিয়েছে, বিদেশি ছাত্রদের উটের মতো নাক গলিয়ে আমেরিকায় ঘাঁটি গাড়তে সাহায্য করছে। অঙ্কটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। দেশের প্রেসিডেন্ট ভালই জানেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাঁর ঘোর বিরোধী, অথচ তাদের গায়ে তাঁর হাত দেওয়ার বিশেষ উপায় নেই। সবচেয়ে ক্ষমতাবান কলেজগুলি বেসরকারি পুঁজিতে চলে, আর এই দেশে পুঁজির অজেয় শক্তি। এই তালে ভোটের আগে তাদের বেশ প্যাঁচে ফেলা গেল। যদিও আপাতত আদালতে একটা রফা হয়ে সেই নির্দেশ রদ হয়েছে, ঘরোয়া রাজনীতির আঁচ শিক্ষাঙ্গনে যে ভাবে পড়েছে তার রেশ এখন চলবে। আর আমেরিকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ঘরোয়া রাজনীতির মেজাজ মেনে চললে তাদের বিশ্ব-অধিনায়কত্বের কতটুকুই বা অবশিষ্ট থাকবে?

এক বার সাক্ষাৎ হয়েছিল এক প্রাক্তন মার্কিন আমলার সঙ্গে, তিনি আশির দশকে কলকাতার মার্কিন দূতাবাসে চাকরি করতেন। কথায় কথায় বলতেন, কলকাতার ছাত্রদের ওপর আমার আলাদা একটা স্নেহ আছে, তারা দুপুরে আমাদের দূতাবাসের সামনে ‘‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম’’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে সন্ধেবেলা আমাদের লাইব্রেরিতে পড়তে আসত। তাঁকে বলেছিলুম, সে আর নতুন কথা কী! আমাদের দেশে মার্ক্সবাদের দুই জনক, মানবেন্দ্রনাথ রায় আর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত— দু’জনেই তো আমেরিকার কলেজ-গ্রন্থাগারে মার্ক্সবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন। আমেরিকায় গিয়ে অনেক ভারতীয় ছাত্র ভিন্ন ধারার রাজনীতি শিখে দেশে ফিরে অমূল্য কীর্তি রেখে যান: কলম্বিয়ায় অর্থনীতি পড়ার সময়ে অম্বেডকর জাতপাত নিয়ে লিখতে শুরু করেন, জন ডিউই-র দর্শন পড়ে, আর কৃষ্ণাঙ্গ জীবন দেখে দলিত-রাজনীতির দিশা পান। দু’দশক পরে জয়প্রকাশ নারায়ণের কথাও বলতে হয়। তিরিশের দশকের মহামন্দার মাথায় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই সমাজতন্ত্রে তাঁর হাতেখড়ি। অম্বেডকর, জয়প্রকাশ নারায়ণ, মানবেন্দ্রনাথ সকলের রাজনীতি আমেরিকার সরকারি নীতির একেবারে অন্য মেরুতে ছিল; তাঁরা শিখেছিলেন মুক্ত শিক্ষাঙ্গনে, যা সরকারের তাঁবে নয়।

আমেরিকার সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে গা না ভাসিয়েও যে সেই দেশ থেকে শিক্ষালাভ করা যায়, এই কথাটা স্বদেশি যুগের চিন্তকরা বেশ জানতেন। জানতেন যে, দেশের আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি করা মানে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকা নয়, অন্যান্য স্বনির্ভর দেশের থেকে শিক্ষা নেওয়া। ইংরেজের চাকরি করতে শেখানো কলেজ ছেড়ে তাই তাঁরা জার্মানি, আমেরিকা, জাপানের মতো দেশের দিকে তাকান। জাতীয় শিক্ষা সমিতি চাঁদা তুলে তহবিল করে কলকাতা ও মফস‌্সলের ছাত্রদের এই সমস্ত দেশ থেকে কাজ শিখে আসতে পাঠায়। হার্ভার্ডে মনস্তত্ত্ব পড়ে এসে কলকাতায় পড়ানো শুরু করেন নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত; হার্ভার্ডেই রসায়ন পড়েন হীরালাল রায়, তাঁর সহকারী বােণশ্বর দাস পড়েন ইলিনয়ে। ফিরে এসে দু’জনে মিলে দেশে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো শুরু করেন; একই সময়ে আয়ওয়া থেকে দাঁতের ডাক্তারি পড়ে কলকাতায় ভারতের প্রথম ডেন্টাল কলেজ খোলেন রফিউদ্দিন আহমেদ। এমনকি যে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার যান্ত্রিক শোষণ, কৃষ্ণাঙ্গ-পীড়ন ও আদিবাসী-হত্যার তীব্র নিন্দা করেন, সেই তিনিই নিজের ছেলেকে ইলিনয়ে হাতেকলমে কৃষিকাজ শিখতে পাঠান। সে যুগের ভারতীয়রা হার্ভার্ড ও হার্ড ওয়ার্কের তফাত করতেন না; কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ধু ধু ইলিনয়ে বীজ বোনা, মই দেওয়া, জঙ্গল কাটা, জমি সরস করার ‘হাড়ভাঙানো কাজ’ শেখেন। সেখানকার গেঁয়ো সমাজে তাঁর মন বসেনি। এক বার তো এক অত্যুৎসাহী মিশনারির সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়লেন। অথচ কৃষিবিজ্ঞান শেখার সময় একাগ্র, কারণ সেখানেই দেশের উন্নতির পথ: ‘‘এখানকার লাঙল দেওয়া যদি দেখ তো অবাক হয়ে যাও’’, কলেজের খেতে চাষ দেখে এসে দিদিমাকে লেখেন, ‘‘আমাদের লাঙল দেওয়া তার কাছে একটু মাটি আঁছড়ানো মনে হয়।’’

লক্ষ কোটি ডলার ঋণ দিয়ে, জাহাজ জাহাজ অস্ত্র বেচে, কোকা কোলা-ম্যাকডোনাল্ড-হলিউড রফতানি করে আমেরিকা যা প্রতিপত্তি পেয়েছে, তার চেয়ে বিশ্ব জুড়ে অনেক গুণ বেশি সম্মান পেয়েছে তাদের শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতায়, গবেষণার উৎকর্ষে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হওয়ার সময়ও, শিক্ষক-ছাত্রদের মতো উলুখাগড়ারা দেশে দেশে সম্পর্ক রাখতে পেরেছে। নেহরু আমেরিকান বিদেশনীতির কড়া সমালোচক ছিলেন; ইন্দিরার আমলে সেই সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে, একাত্তরের যুদ্ধে তো আমেরিকা পাকিস্তানের সমর্থনে যুদ্ধজাহাজই পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই টালমাটাল সময়েও ভারতের কৃষিবিজ্ঞানীরা আমেরিকার বিজ্ঞানীদের সাহায্যে দেশের কৃষি-উৎপাদনে সাহায্য করেছেন; সেই সময়েই আমার এক দাদু, যাঁকে কোনও ভাবেই মার্কিন সংস্কৃতির প্রতিভূ বলা যায় না, মার্কিন ফেলোশিপ নিয়ে মেক্সিকোয় সবুজ-বিপ্লবের জনক নরমান বোরলগের কাছে ভুট্টা চাষ শিখতে যান, ফিরে এসে বাকি জীবন ধরে রাঁচীতে ভুট্টা নিয়ে গবেষণা করেন। কালের নিয়মে ভিয়েতনাম, একাত্তরের যুদ্ধজাহাজের স্মৃতি মুছে গিয়েছে। আজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট গুজরাতে জনসভা করেন। সবুজ-বিপ্লবের উত্তরাধিকার, তা ভাল-খারাপ যা-ই হোক, পৃথিবী জুড়ে আজও চলছে; আমেরিকার প্রকৃত জিত হয়েছে জ্ঞানে, যুদ্ধে নয়।

এখন মুষলপর্ব: বিশ্বায়নের চাপে অন্দরমহলের দারিদ্রে ক্লিষ্ট আমেরিকা বিশ্বের ভার বওয়া থেকে মুক্তি চাইছে, পঞ্চাশের দশকে ব্রিটেনের মতো। কিন্তু ঘরোয়া রাজনীতির মাসুল বিদেশি ছাত্রদের চোকাতে হলে মার্কিন ইজ্জতের শেষ পরতটুকুও উঠে যাবে। শিক্ষার বিশ্বায়ন থেমে থাকে না। উনিশ শতকে নেতৃত্ব দিয়েছিল জার্মানি, বিশ শতকে আমেরিকা, একুশ শতকে হয়তো পড়ে থাকবে চিন। আবুজ়ার কাবুলে তার বাবার স্কুলটি চালাতে থাকবে। শুধু যে বিশ্বাস নিয়ে যুদ্ধের শত্রুতা ভুলে আমেরিকায় পড়তে এসেছিল, ইতিহাস হয়ে যাবে সেটা।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সন্দীপন মিত্র

ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি

অন্য বিষয়গুলি:

Refugee History America Pakistan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy