মুলুক গ্রামে শ্রী শ্রী রামকানাই মন্দিরের শ্রী বিগ্রহের মন্দির পরিক্রমা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
বোলপুর শহর থেকে প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে বোলপুর-পালিতপুর রাস্তার ধারে কৃষ্ণনাম সারা অঙ্গে মেখে ছোট্ট গ্রাম মুলুক। এই গ্রামখানি আম, জাম, তমাল গাছে পরিবৃত হয়ে ধ্যানগম্ভীর শিবশম্ভুর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। এক অসাধারণ ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুলুক গ্রামের নাম।
শ্রীচৈতনোত্তর কালে এই কৃষ্ণাঙ্গন এক অন্য মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ছিল। বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র হিসেবেও মুলুকের অবদান ছিল চিরস্মরণীয়, অনস্বীকার্য। বাংলার বক্ষে কৃষ্ণনামকে যেন স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করে দিয়েছিল সে। তবে শ্রীপাঠ মুলুকের ইতিবৃত্ত শুধুমাত্র কতকগুলো গ্রাম্য কথা-কাহিনির মধ্যেই সীমায়িত নয়। মুলুকের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে ‘জলন্দার গড়’-এর কাহিনি। যা আজ জলুন্দি গ্রাম নামে পরিচিত।
মহাপ্রভুর অনুবর্তীদের কার্যকলাপের মাধ্যমে তৎকালীন যুগে বাংলার বিভিন্ন স্থান তথা ক্ষেত্র কৃষ্ণপ্রেমীদের কৃষ্ণলীলার রস আস্বাদনের কেন্দ্র হিসাবে উন্মোচিত হয়েছিল। জলন্দার গড় (জলুন্দি) ছিল সেই রকমেরই এক কেন্দ্র। যেখানে চৈতন্যদেবের অন্যতম প্রিয় পার্ষদ ধনঞ্জয় ঠাকুরের বাসভূমি। সেই হিসেবে জলন্দার গড়ের গৌরবময় যুগের শুরু আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। এই জলুন্দিতেই শ্রীপাট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ধনঞ্জয় ঠাকুর। সেটিই সম্ভবত বীরভূমের প্রথম শ্রীপাট। জলন্দার গড়ের অনতিদূরেই মুলুক গ্রামের অবস্থান। এবং মুলুকের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন রামকানাই ঠাকুর। এই রামকানাই ছিলেন ধনঞ্জয় পণ্ডিতের কনিষ্ঠ ভ্রাতা তথা শিষ্য সঞ্জয় পণ্ডিতের বংশধর। রামকানাই ঠাকুরের পিতা যদুচৈতন্য আদিকাল থেকেই ছিলেন কৃষ্ণগত প্রাণ। মুলুক গ্রামে শ্রীপাটের প্রতিষ্ঠাতাও রামকানাই। এখানে দেবী অপরাজিতার পুজো প্রচলনও তাঁর হাত ধরে।
রামকানাই ঠাকুরের শ্রীপাট মুলুকে পদার্পণ সম্পর্কিত উপাখ্যানটি ছিল কৃষ্ণভাবময়। প্রবাদ অনুযায়ী, তিনি বৃন্দাবন যাত্রাকালে পথের ক্লান্তির অবসান ঘটাতে কখনও মুলুক নামক গ্রামে এক বটবৃক্ষের নীচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অস্তগামী সূর্যালোকে গরুর পাল ও রাখাল বালকের দল দেখে ও তাদের মুরলীর ধ্বনিতে বিভোর হয়ে যান এবং তাঁর অন্তরের মধ্যে জাগ্রত হয়ে ওঠে বৃন্দাবনের কৃষ্ণলীলার স্মৃতি। উপলব্ধি করেন কৃষ্ণপ্রেমের মাহাত্ম্য এবং তারই ফলশ্রুতিতে শ্রীপাট মুলুক আখ্যাত হয় গুপ্তবৃন্দাবন নামে।
মুলুক উত্থানের অন্য এক লোককথাও প্রচলিত। তা অনুযায়ী, একদিন গোপ বালকেরা ধবলীর পাল নিয়ে গ্রামে ফিরে আসার সময় গোধূলির রক্তিম আলোয় বনচ্ছায়াতলে এক ব্রাহ্মণ যুবককে দেখে। সেই ব্রাহ্মণ যুবক তখন কৃষ্ণনামে তন্ময়, চোখে তাঁর অবিরত বারিধারা। সেই বালকেরা ব্রাহ্মণের সেই দেহভাব দেখে, ঈশ্বরের প্রতি অকুণ্ঠিত, পবিত্র আন্তরিক ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। তাদের ধারণা হয় সেই যুবক আসলে দেব-অংশসম্ভুত, ঈশ্বর প্রেরিত। তারা সেই অচেনা মানুষটিকে মহানন্দে সসম্মানে গ্রামে নিয়ে আসে এবং তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করে। এই যুবকটি হলেন খ্যাতনামা রামকানাই ঠাকুর।
আবার কারও কারও মতানুযায়ী, রামকানাই ঠাকুর লেখাপড়ার কারণে পিতার কাছে তিরস্কারের ভয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং সন্ধ্যাসমাগমে মুলুক প্রান্তরে এসে উপস্থিত হন। গোধূলির আলোয় রাখালের বংশীধ্বনি তাঁর অন্তরের মধ্যে রাখাল রাজার স্মৃতি জাগরিত করে। তিনি উত্তর গোষ্ঠের গানে বিভোর হন এবং তারই ফলস্বরূপ মানবিক প্রেম-ভক্তির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এই স্থানে বসবাস শুরু করেন।
তবে এই শ্রীপাট মুলুকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। ইতিহাসলব্ধ তথ্য থেকে বলা যায়, এই মুলুক গ্রামের পূর্ব নাম ছিল মল্লিকপুর। পরে সুলতান গিয়াউদ্দিন ইয়ুজের সেনাপতি মুলুক খান তাঁর নিজের নাম অনুসারে মল্লিকপুরের নামকরণ করেন মুলুক। তবে জনশ্রুতি আছে, কোনও এক সময়ে রামকানাই ঠাকুর সুলতানকে ‘মুলুক খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই সূত্র ধরেই তাঁর সম্মানে গ্রামটি মুলুক নামে পরিচিত হয়। তবে হিন্দু ধর্মসাধনার এই লীলাক্ষেত্র মুসলমান সেনানায়ক তথা শাসকের নাম থেকেই নামাঙ্কিত হয়েছিল, তাতে কোনও মতভেদ নেই।
প্রসঙ্গত আরও উল্লিখিত হয় যে রামকানাই ঠাকুর মুলুকে বসবাসের ভাবনা স্থির করলে, তাঁর নিজের বাস্তুবাড়ি তৈরি করার উদ্দেশ্যে মাটির সন্ধান করতে করতে পৌঁছে যান জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে তিনি মাটি খুঁড়তে শুরু করেন এবং মাটির ভিতর থেকে এক দেবীমূর্তির সন্ধান পান। তিনি তখনই সেই দেবীমূর্তিকে সসম্মানে তাঁর কোলে তুলে নেন। এই দেবীমূর্তি ছিল চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনীর। রামকানাই ঠাকুর সেই দেবী চতুর্ভুজার নাম দেন ‘অপরাজিতা দেবী’ এবং তাকে তিনি নিজ গৃহে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময় থেকেই শারদ শুক্লপক্ষে সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবীর বিহিত পূজাব্যবস্থা আজও অনুসৃত হয়ে আসছে। এই মহাশক্তির প্রতিষ্ঠার পরেই রামকানাই নিজ নামে এক মহাদেব প্রতিষ্ঠা করেন। এই মহাদেবই পরে রামেশ্বর রূপে পূজিত হন এবং তার পাশাপাশি ঠাকুর রামকানাইও প্রেমের দেবতা রূপে পরিগণিত হন। রামকানাই প্রতিষ্ঠিত দেবী অপরাজিতার এবং রামকানাইদেবের পুজো রাঢ়বঙ্গের বীরভূমিতে বৈষ্ণব ও শক্তিসাধনার বিস্ময়কর সম্মিলনের নিদর্শনরূপে গণ্য হয়ে থাকে।
রামকানাই ঠাকুরের মুলুকে আগমন, বসবাস এবং গোষ্ঠযাত্রার স্মৃতি স্মরণে প্রতি বছর গোষ্ঠাষ্টমীতে মুলুককে কেন্দ্র করে রামকানাইদেবের বিশেষ পূজানুষ্ঠান এবং প্রধান মেলা উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই উৎসবে হরিনাম সংকীর্তন, বাউল, নানা ধরনের মন্ত্রপাঠ হয়ে থাকে। প্রভু রামকানাই নবরূপে সুসজ্জিত হয়ে ওঠেন। অষ্টমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত মেলার স্থায়িত্ব কাল। সেখানে উৎসব উপলক্ষে নানা ধর্মের, সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে। জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসবে মুলুকের রামকানাই মন্দির প্রাঙ্গণে এক বিশেষ ধরনের নারকোল খেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তা ছাড়াও জ্যৈষ্ঠ মাসে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন, ঝুলনযাত্রা, রথযাত্রা ইত্যাদি উৎসবগুলিও বিশেষ সমারোহের সঙ্গে পালিত হয়।
রামকানাই মন্দিরের মধ্যে প্রাচীন দালানরীতি লক্ষ্য করা যায়। ছোট ছোট খিলানে সাজানো বারান্দা এবং গর্ভগৃহের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি ছাড়াও গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মূর্তি, নবগোপালের কষ্টিপাথরের অসংখ্য শালগ্রাম শিলা এবং গণেশের মূর্তিও রয়েছেয। মুলুকের মন্দির চত্বরের পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও স্বমহিমায় চিরজ্জ্বল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অপরাজিতা দেবীর মন্দির, শিবমন্দির সমূহ, ভাতুরার মাঠ প্রভৃতি।
এ কথা বলাই যায় যে, বীরভূমের ধর্মসাধনার প্রধান বৈশিষ্ট্যটুকু সহজেই ধরা পড়েছে ছোট্ট গ্রাম মুলুকের ধর্মসংস্কৃতির ইতিবৃত্তে। তাই পর্যটকেরা প্রায়শই শান্তিনিকেতনের পাশাপাশি ভিড় করে থাকেন মুলুকের নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে।
(লেখক বিশ্বভারতীর ছাত্র, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy