এরকমই কোনও জমায়েতে তৈরি হয়ে যায় ভাললাগার মুহূর্ত। নিজস্ব চিত্র
অষ্টমীর সকাল। পাড়ার মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ছিল ছেলেটি। একটু যেন অস্থির। বারবার স্মার্টফোনে আঙুল দিয়ে ঠুকঠুক করছিল। ছেলেটি নিশ্চয় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে ব্যস্ত, ভাবছিলেন সাগ্নিক। অস্থিরমতিকে অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিলেন সাগ্নিক। পত্নী আর কন্যা মণ্ডপে ঢুকেছে অঞ্জলি দিতে। আর তিনি দুই লক্ষ নিয়ে বসে রয়েছেন। একটি চোখ দু’জোড়া জুতোর দিকে। পত্নী আর কন্যার খুলে যাওয়া জুতো সামলানোর দায়িত্ব তাঁরই। একটা চেয়ার টেনে বসে সেই দায়িত্ব পালনের ফাঁকেই সাগ্নিকের চোখ চলে গিয়েছিল ছেলেটার দিকে। মণ্ডপের ঢাকের আওয়াজ, মন্ত্রপাঠ, অঞ্জলি দেওয়ার ভিড়, কোনও কিছুই যেন ছেলেটাকে ভাবাচ্ছে না। মণ্ডপের চারিদিকে অনেক রঙের আনাগোনা। তাতেও কোনও হেলদোল নেই ছেলেটির। শুধু হাতে ফোন নিয়ে কীসের যেন ব্যস্ততা। অল্প সময়ের মধ্যে বার পাঁচেক কাকে যেন ফোনও করে ফেলল। অল্প বিস্তর রাগারাগিও করল।
আরও কিছুক্ষণ অস্থিরতার পরে ছেলেটির সামনে এক কিশোরীর আগমন। কিশোরীর মুখে খানিকটা অপরাধী অপরাধী ভাব। কানখাড়া সাগ্নিকের। শুনতে পেলেন, মেয়েটিকে দেখে ছেলেটা বলে, ‘‘এই তোর আসার সময়। কখন থেকে অপেক্ষা করছি। পুজোর এই একটা দিনই তো তোর সঙ্গে নিশ্চিতে ঘোরা যায়।’’ এর পরে মেয়েটির হাত ধরে মণ্ডপ থেকে ছেলেটির প্রস্থান।
বিষয়টা এতক্ষণে পরিষ্কার হয় সাগ্নিকের কাছে। এরা দু’জনে তাহলে প্রেমিক-প্রেমিকা। এর পরে স্মৃতি পিছনে হাঁটা ছাড়া গতি নেই। প্রেম করেই যে বিয়ে তাঁদের। তাঁর নিজের সম্পর্কের শুরুও এক দুর্গাপুজোতেই। কিন্তু বছর ১৭-১৮ আগের ঝাড়গ্রাম শহরে পুজোর প্রেমের সঙ্গে আজকের অষ্টমীর বিস্তর ফারাক। আজ, মেয়েটার আসতে দেরি হচ্ছে বলে ছেলেটা এতবার টেক্সট আর ফোন করে তার খোঁজ নিতে পারছে। কিন্তু তাঁদের সময়! সাগ্নিকের মনে আছে, তাঁরা বন্ধুরা মিলে পুজোতে এভাবেই বেরোতেন। কিন্তু বিশেষ বান্ধবীর সঙ্গে দেখে করতে হলে বা দেখা করার দিনক্ষণ জানাতে ভরসা ছিল সখী বা দূতী। নিদেন পক্ষে কোনও ‘কমন ফ্রেন্ড’। তখন ল্যান্ডলাইনের যুগ। কিন্তু ফোন করে ‘ডেটিং’এ নিয়ে যাওয়ার উপায় কী! কে ফোন তুলবেন তার কোনও ঠিক আছে? বাবা কিংবা মা তুললে তো সর্বনাশ। হয় গলা দিয়ে স্বর বেরবে না। নয় তো-তো করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ফলে বন্ধুরাই ভরসা। জানিয়ে দেওয়া হল, অষ্টমী বা নবমীতে দাঁড়াতে হবে কোন সংকেত স্থানে। সেটা হতে পারে কোনও মণ্ডপ বা কোনও সিনেমা হল।
সাগ্নিক মনে মনে হাসেন। খবর তো দেওয়া হল। কিন্তু তিনি সঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বেরতে পারেননি। ফলে সাইকেল নিয়ে সংকেত স্থান থেকে প্রেমিকার বাড়ির গলি পর্যন্ত আনাগোনা। সাগ্নিক ভাবেন, তখন যদি হোয়াটসঅ্যাপ থাকত! শুধু একটা নোটিফিকেশন।
শহরেরই ছেলে জয়দীপ সরকার। সাগ্নিকের মতো তাঁরও প্রেম করে বিয়ে। জয়দীপ বলছিলেন, ‘‘এখনকার ছেলে মেয়েদের দেখে ভালই লাগে। পুজোতে পার্কে কচিকাঁচাদের যে ভিড় হয়, তা অন্য কোথাও আর হয় না। হয়তো এখানে পুজোর এই ভিড়েই কত জন একে অপরের প্রেমে পড়ছে। আমাদের সময়ও ভিড় হত। তবে এখনকার মতো নয়।’’ তিনি জানালেন, তখন শহরে এত ঘোরার জায়গাও তো ছিল না। হয় হাসপাতাল লাগোয়া একটি ক্লাবের পুজো মণ্ডপ, না হলে সাইকেল ঠেঙিয়ে সেই ডিয়ার পার্ক। পুজোর সময় হাতেগোনা দু’একটা রেস্তরাঁ ছাড়া খাবারের দোকানও ছিল না। পুজোর দিনগুলোতে অস্থায়ী বেশ কিছু দোকান হত। ভেজিটেবল চপ, ফিশ চপ বানাত। কোনও কোনও স্টলে এগরোল, চাউমিন। স্কুল কলেজে পড়া ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে সেই স্টলে ভিড় করত। খেতে খেতেই হয়তো সিনেমা দেখার পরিকল্পনা। জয়দীপরা স্কুলে পড়ার সময়ে ‘কোই মিল গয়া’ দেখেছিলেন। পরে শহরে এল খোলামেলা চত্বরের এক রেস্তরাঁ। কী ভিড় তাতে! টেবিলে টেবিলে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে মিশে থাকত যুগলেরা।
এখন শহরটা কলেবরে বেড়েছে। সদ্য জেলাও হয়েছে। স্মার্টফোনের যুগে তেমন আর অপেক্ষা করতে হয় না একে অন্যকে। হাসপাতাল লাগোয়া পুজো মণ্ডপের সেই স্কুল আর কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের ভিড়টাও গিয়েছে থানা সংলগ্ন একটা পার্কের দিকে। আর রেস্তরাঁ আর পার্কের তো ছড়াছড়ি। এখন পুজোর প্রেমের রূপটাও অনেক বদল হয়েছে। বলছিলেন মেদিনীপুর শহরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণী। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ের পুজোয় তাঁর জীবনে প্রেম এসেছিল। কিন্তু সে যেন ভীরু হরিণীর অবস্থা। প্রেমিক সাইকেলে। চেনা কেউ দেখা দিলেই সাইকেলে উধাও হয়ে যাবে। কেউ এসে পড়ার ভয়ে প্রেমিকা তো নতুন শাড়ির আঁচল পাকিয়ে পাকিয়ে দড়ি করে ফেলেছে প্রায়। একটু দূরে দু’তরফের দুই পাহারাদার। আগেভাগে সতর্ক করে দেবে।
তবে সেই ভীরু ভীরু যুগল এখন খুব একটা দেখা যায় না। ঝাড়গ্রামের এক পুরনো প্রেমিকের কথায়, ‘‘আগে পুজোতেও রাস্তাঘাটে গুরুজনদের নজর এড়িয়ে প্রেম করতাম। সে তুলনায় এখন তো ওরা আমাদের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আগে আমরা সাইকেলের ক্যারিয়ারে বান্ধবীদের নিয়ে হাতে গোনা কয়েকটা মণ্ডপে যেতে পারতাম। আর এখন তো সকলেরই কাছে মোটরবাইক।’’ পরিবর্তন যে হয়েছে, তা মানছে নবীনেরাও। প্রেমিকার সঙ্গে মণ্ডপে ঘুরছিল শৌর্য (নাম পরিবর্তিত)। সে বলে, ‘‘যতই লুকিয়ে থাকি না কেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কেউ না কেউ আমাদের খুঁজে পেয়েই যাবে। তাই মণ্ডপে মণ্ডপে হাত ধরেই ঘুরছি।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর এক স্কুল পড়ুয়ার কথায়, ‘‘পুজোয় এক জনকে ভাল লেগেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করব।’’ এই খোলামেলা ভাবের কারণে এখন আর মেদিনীপুরের তরুণীর সময়ের মতো প্রেম করতে পাহারাদার লাগে না। বন্ধু-বান্ধবীদের জটলার মধ্যেই মিলেমিশে থাকে যুগল। প্রবল আড্ডার মধ্যেই তারা হোয়াটসঅ্যাপে ইমোজি আদানপ্রদান। ‘লাভ-অ্যাংরি-ভেংচি’।
পুজোয় প্রেম ছিল, আছে, থাকবে। থাকবে দীর্ঘশ্বাসও। ছিলও। আগে যেমন বাইকওয়ালা বন্ধু ‘প্রিভিলেজড’ হত। আর বাকিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলত। এখন স্কুলবেলার প্রেমের পুজো মণ্ডপে বিবাহিতা প্রেমিকা যখন কোলে সন্তানকে তুলে দেয়, হৃদয় ফুঁড়ে ব্যথাই জাগে।
পুজোর প্রেমের অনিবার্য এবং অন্যরকম নির্যাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy