ঝাড়খণ্ডের রামচরণ মুন্ডা ব্যতিক্রমী। মৃত্যুর ধরনে নহে। ৬৫ বৎসরের এই বৃদ্ধ যে কারণে মারা গেলেন, গত দুই বৎসরে সেই রাজ্যে আরও অন্তত ২১টি মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই একই অভিযোগ উঠিয়াছে— রেশন না পাওয়ার ফলে অনাহারে মৃত্যু। রামচরণ ব্যতিক্রমী, কারণ এই প্রথম ঝাড়খণ্ডের প্রশাসন এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করিল। কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছেন, কে কী পরিমাণে রেশন পাইয়াছেন, সেই তালিকায় গত দুই মাসে রামচরণের নামের পার্শ্বে একটিই সংখ্যা লেখা। শূন্য। দুই বৎসর পূর্বে তাঁহার পুত্রের মৃত্যু হইয়াছিল যক্ষ্মায়। বাড়িতে আছেন কেবল স্ত্রী ও এক কন্যা। অনুমান করা চলে, গণবণ্টন ব্যবস্থার চাল-গম না পাইলে এহেন পরিবারে হাঁড়ি চড়াইবার কোনও উপায় থাকে না। রামচরণের মৃত্যুর কারণ সন্ধানে আর দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। এক্ষণে প্রশ্ন, দুই মাস যাবৎ রামচরণ রেশনের খাদ্য পাইলেন না কেন? তাহার কারণ, ইন্টারনেট-নির্ভর বায়োমেট্রিক পরিচিতি যাচাই ব্যবস্থাটি কাজ করে নাই। তিনিই যে ‘রামচরণ মুন্ডা’, ব্যবস্থা সেই প্রমাণ পায় নাই। ফলে, খাবারও জোটে নাই তাঁহার। সন্তোষী কুমারীর কথা স্মরণে থাকিতে পারে। বৎসরাধিক কাল পূর্বে ঝাড়খণ্ডেই একাদশ বর্ষীয়া বালিকাটি অনাহারে মারা গিয়াছিল বলিয়া অভিযোগ— তাহাদের পরিবারের আধার কার্ডের সহিত রেশন কার্ডের সংযুক্তিকরণ না হওয়ায় রেশন বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। এই মৃত্যুগুলি যে স্বাভাবিক মৃত্যু নহে, এক অর্থে হত্যাকাণ্ড— রাষ্ট্রীয় অবহেলার হাতে সাধারণ মানুষের জীবনহানি, তাহা অস্বীকার করিবার কোনও উপায় আছে কি?
প্রশ্ন উঠিবে, তবে কি প্রযুক্তির সাহায্য লওয়া অন্যায়? গণবণ্টন ব্যবস্থায় বিপুল চুরি ঠেকাইতে বায়োমেট্রিক তথ্য যাচাইয়ের পথে হাঁটা অপরাধ? প্রযুক্তিকে দোষ দেওয়ার প্রশ্ন নাই। প্রশ্ন হইল, সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের দায়িত্ব যাঁহাদের হাতে, সেই বিবিধ স্তরের আধিকারিকদের মানসিকতা লইয়া। প্রথম কথা, ভারতে খাদ্যের অধিকার সংবিধানস্বীকৃত। কোনও কারণেই কাহাকে সেই অধিকার হইতে বঞ্চিত করা চলে না। কাহারও আধার কার্ড হয় নাই, অথবা আধারের তথ্যের সহিত কাহারও অঙ্গুলির ছাপ মিলিতেছে না, এই যুক্তিকে তাঁহাদের খাদ্যের অধিকার কাড়িয়া লওয়া যায় না। যন্ত্র যন্ত্রের কাজ করিবে— অথবা, ভারতের ন্যায় দেশে, কাজ করিতে ব্যর্থ হইবে— কিন্তু, মানুষ নিজের মনুষ্যত্ব বিস্মৃত হইবে কেন? যে ব্যক্তির হাতে খাদ্যবণ্টনের দায়িত্ব, তিনি নিজেকে ‘যন্ত্র’ ভাবিতে পারেন না। এক জন হতদরিদ্র মানুষ দুই মাস যাবৎ খাবার তুলিতে পারিতেছেন না, এমন ঘটনা কেন তাঁহাদের বিচলিত করিবে না, বিকল্প খুঁজিতে বাধ্য করিবে না? তাঁহার হাতে যদি উপায় না-ও থাকে, তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হইবেন না? স্বীকার করুক আর না-ই করুক, গণবণ্টন ব্যবস্থায় খাবার না পাইয়া মানুষ যে মারা যাইতেছে, এই খবর রাজ্যের প্রশাসনের নিকট থাকাই স্বাভাবিক। যাহাতে কেহ খাদ্য হইতে বঞ্চিত না হন, তাহা নিশ্চিত করিতে তাহারাই বা যথোপযুক্ত নির্দেশ দিবে না কেন? বৃহত্তম দায় কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের। এমন ঘটনা যে ঘটিতে পারে— এবং, ঘটিতেছে— তাহা জানিয়াও ঠেকাইবার পথ সন্ধান করিলেন না কেন? এই মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রযন্ত্র অস্বীকার করিবে কী ভাবে? যে মানুষগুলি রেশন দোকানের খাবারের ভরসায় বাঁচেন, রাষ্ট্র যে তাঁহাদের দয়া করিতেছে না, এই কথাটি স্পষ্ট করিয়া লওয়া ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy