মেকিয়াভেলি বলেছিলেন, সফল রাজাকে মিথ্যা কথা বলতেই হবে। রাজাকে দেখাতে হবে তিনি কতটা প্রজাবৎসল! আসলে তিনি প্রজাদের জন্য প্রাণপাত না করলেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য এ সব মিথ্যাভাষণ দিতে বাধ্য। শেক্সপিয়রের মতো নাট্যকারের বহু চরিত্রে, তা সে ওথেলোই হোক আর ম্যাকবেথ বা সিজার— মেকিয়াভেলির প্রভাব প্রবল। ভারতীয় কূটনীতিক কৌটিল্যের দর্শনে বাস্তববোধ যতই থাকুক না কেন, সততার মূল্যবোধ কিন্তু ছিল প্রবল। ভারতীয় দর্শনের শিকড় যে উপনিষদের মধ্যে নিহিত সেখানেও কিন্তু আছে রাজনৈতিক ও মানবিক বহুত্ববাদ। আকবরের দীন-ইলাহি থেকে অশোক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের দেশশাসনে মানবতাবাদের শিকড় ছিল। যতই ধর্মীয় রেষারেষি, যুদ্ধ ও হানাহানি হোক না কেন!
সমস্যা হচ্ছে, আজকের ভারত ও আজকের বাংলায় এই পরমত সহিষ্ণুতার মানবধর্ম কোথায় যেন অবলুপ্ত হতে বসেছে। বাঙালির মানবধর্মের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন, তাই আজ আমরা যতই পারস্পরিক বিদ্বেষের রাজনীতির অবক্ষয়ের শিকার, ততই স্তব্ধ হচ্ছে উন্নয়ন। বন্ধ্যা হচ্ছে অর্থনীতি-সংস্কৃতি-রাজনীতি। হারিয়ে গেল হিউম্যানিজম নামক তত্ত্বটি!
হিউম্যানিজম নামক ধারণাটির দু’টি দিক ছিল। একটি মানুষের হৃদয়ের দিক। অন্যটি মানুষের বিচারবুদ্ধির দিক। মানুষের প্রতি মানুষের বা জীবন ও জগতের প্রতি মানুষের যে অনুরাগ তা-ও যেমন শিল্পের হিউম্যানিজম, আবার জীবন ও জগৎকে বিশ্লেষণ ও বিচার করে সমাজজীবনের যাত্রাকেও হিউম্যানিজমের একটি বিশেষ অভিব্যক্তি বলে মনে করা হয়। এই বুদ্ধিবিচার মানুষের জন্য মানুষের বিচার। মহাভারতে আছে, ভীম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, গুহ্য একটা তত্ত্ব তোমাকে বলছি, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিছুই নাই। এ যেন একেবারে এ কালেরই কথা। মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কি ব্রহ্ম নন? ঈশ্বর নন? দেহজীবনের চেয়ে বড় কি অধ্যাত্বজীবন নয়? ভবতোষ দত্ত তাঁর ‘বাঙালির মানবধর্ম’ গ্রন্থে বলেছেন, এই চিন্তাই মানবতাবাদ, ইংরাজিতে একেই বলা হয় হিউম্যানিজম! বুদ্ধদেব ঈশ্বরের কথা বলেননি, কিন্তু তিনিও মানুষের দুঃখ মোচনের কথা বলেন। কার্ল মার্কসও তো তাই।
আজকাল রাজনীতিতে মতাদর্শ ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। অনেক চিন্তাবিদ বলছেন, ক্রমশ দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলিই একই রকম আচরণ দেখাচ্ছে! রণবীর সমাদ্দার একটি প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই কেন একই রকম ব্যবহার করে? তার কারণ বোধহয় বাস্তববোধের নামে মানবতাবাদ এবং মতাদর্শ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
কিছু দিন আগে পারিসে দার্শনিকদের একটি সম্মেলন হয়েছিল। তাতে বিষয়বস্তু ছিল বক্তব্যহীনতা। তত্ত্বহীনতা। বহু দার্শনিক বলেন যে, তত্ত্ব এবং মতাদর্শ— এর আর কোনও প্রয়োজন নেই। যে কোনও জিনিসকেই বিশেষ থেকে সাধারণে নিয়ে গিয়ে একটা তত্ত্ব তৈরি করার দিন শেষ হয়েছে। এখন চাই প্রয়োগবাদ। একে বলা যেতে পারে উপযোগী প্রযুক্তি বা অ্যাপ্রোপিয়েট টেকনোলজি। প্যারিসে অ্যান্টি ফিলজফি নামে এই এক নতুন ধরনের দার্শনিক মতবাদ হিসাবে জনপ্রিয় হয়েছে। এর পাল্টা সমালোচনায় অনেকে বলছেন, দর্শন বা তত্ত্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই দার্শনিকেরা নতুন তত্ত্বের অবতারণা করছেন মাত্র। আসলে তত্ত্ব থেকে মুক্তি নেই। মানুষের মূল্যবোধ যত দিন আছে, বিবেক যত দিন আছে, তত দিন নৈতিকতা আছে। উচিত-অনুচিতের এথিক্স রয়েছে। কান্ট যেটা বলেছিলেন, ন্যায়ের প্রশ্নে কোনও ছুটির দিন নেই (দেয়ার ইজ নো হলিডে ইন ভার্চু)। সে কথা আজও সত্য। কী পদ্ধতিতে মানুষের দুঃখ দূর হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু তার ভিত্তিতেই মতাদর্শগত পথ তৈরি হয়। এক একটি দল এক একটি মতাদর্শ অনুসরণ করে চলে। কিন্তু বাস্তবে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে হবস কিম্বা মেকিয়ভেলিকে গুরুঠাকুর মেনে আমরা যদি মনুষ্য বিরোধিতার জয়গান গাইতে যাই, তা হলে আর যা-ই হোক, সেটা কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য নয়।
অনুব্রত মণ্ডল যেটা করছেন সেটা অন্যায়। এটা বলার মানে আমি কোনও একটি রাজনৈতিক দলের বিরোধী বা অন্য কোনও দলের পৃষ্ঠপোষক, দোহাই এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন না। সিপিএম নেতা আনিসুর রহমান যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিলেন তখন তিনিও কিন্তু সেই একই অশালীনতার দোষে দুষ্ট ছিলেন এবং তার সমালোচনা করার মানে কিন্তু সিপিএম বিরোধিতাও ছিল না। গোটা ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে আজ এক তু তু ম্যায় ম্যায়-এর রাজনীতি চলছে। এটা আমরা-ওরা রাজনীতি। এটা বিভেদের রাজনীতি। এটা বনামের রাজনীতি। এই রাজনীতি এই মুহূর্তে বড় পীড়া দিচ্ছে। সে দিন গুজরাতে সরকারের দেওয়া চিনের ভুল মানচিত্র নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল ‘টাইমস নাউ’ চ্যানেলে। আমি বলেছিলাম, ভুল মানচিত্র দেওয়াটা একটা বড় আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি। এটি ক্ষমাহীন অপরাধ। এর জন্য শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু তাই বলে এই ঘটনার জন্য সামগ্রিক ভাবে মোদীর চিন সম্পর্কিত বিদেশনীতির সামলোচনা করব কেন? সেটি পৃথক আলোচনার বিষয়। অর্ণব গোস্বামী বলেছিলেন, তুমি দু’দিকেরই পক্ষে বলছ। তোমাকে একটা পক্ষ নিতে হবে। আমি বলেছিলাম। এটা তো কলেজ বিতর্ক নয়। বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বিতর্কসভা নয়। এটা একটা বাস্তব রাজনৈতিক ঘটনা যার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করছি আমরা। রাজনৈতিক নেতারা দলীয় পক্ষ নিতে পারেন। সাংবাদিক পক্ষ নিতে বাধ্য নন। সাংবাদিক তো গোটা ঘটনাটার মূল্যায়ন করবেন।
যে কোনও কারণেই এই বনামের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে গোটা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করার মানসিকতা আমরা কোথাও হারিয়ে ফেলছি। আর এই সমস্যাটা কিন্তু শুধু রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটা বোধহয় আমাদের মানবধর্মের সঙ্কটও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy