জওহরলাল নেহরু তখন প্রধানমন্ত্রী। লেডি মাউন্টব্যাটেনের দিল্লি আসার কথা ঘোষণা হয়েছে। স্বাধীনতার পর মাউন্টব্যাটেন-পরিবার দেশ ছাড়েন। তার পর কেন লেডি মাউন্টব্যাটেন হঠাৎ দিল্লি আসার পরিকল্পনা নিয়েছেন তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে যায়। রাজ্যসভায় তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা পি সুন্দরাইয়া সরাসরি নেহরুকে আক্রমণ করেন। লেডি মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক নিয়ে সে দিনও নানা রকম গল্পকথা চাউর ছিল। সুন্দরাইয়া ছিলেন বাম সংসদীয় নেতা। তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য শুনে নেহরু রেগে অগ্নিশর্মা। প্রবল কথা কাটাকাটি। সর্বপল্লী তখন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা উপরাষ্ট্রপতি। সেই বাগবিতণ্ডার পর বিকেলে রাধাকৃষ্ণণ ফোন করেন সুন্দরাইয়াকে। বলেন, নেহরু এক চা চক্রে সন্ধ্যায় তাঁর বাসভবনে কতিপয় সাংসদকে ডেকেছেন, সেখানে সুন্দরাইয়াও আমন্ত্রিত। সুন্দরাইয়া যান এবং নেহরু সেখানে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। সুন্দরাইয়াও নেহরুকে দেখে বলেন, “আমি দুঃখিত। আমার অমন কথা বলা উচিত হয়নি।” আবার নেহরুও বলেন, “না, দোষ তো আমার। আমার এত ওভার রিঅ্যাক্ট করা অনুচিত হয়েছে।” সুন্দরাইয়ার আত্মজীবনী থেকে এই ঘটনার কথা জানা যায়। আবার সুন্দরাইয়ার স্ত্রী-র আত্মকথাতেও এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।
এ বার ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নেতারাই শুধু নন, টিভি চ্যানেলগুলিতে যে ভাবে ভোট বিশেষজ্ঞরাও এক ভয়ঙ্কর কলহে লিপ্ত ছিলেন, ফেসবুক ট্যুইটারেও যে ভাবে ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ সংস্কৃতি দেখলাম, তা দেখে প্রতি দিন বিষণ্ণ হয়ে যেতাম। রাতে আইপ্যাড বা ইউটিউবে মতান্তরের বদলে মনান্তরের তুফান দেখে রোজ ভেবেছি। গত এক মাস ধরে ভেবেছি কেন এমন হচ্ছে? গণতন্ত্র মানেই তো মতপার্থক্য। সেটাই তো বহুত্ববাদ। আমার পুত্রের বয়স ২৫। ওর সঙ্গেই আমার নানা বিষয়ে মতপার্থক্য হয়। আমার বাবার সঙ্গেও আমার মতপার্থক্য ছিল। অল্প বয়সে আমি যখন ঘোরতর বামপন্থী মার্কসবাদী, তখন আমার বাবা আদি কংগ্রেসের সমর্থক। কিন্তু তা বলে কি বাবা-ছেলের মধ্যে সামাজিক বয়কট হয়েছে? এমনকী, একই পরিবারে দুই ভাই দু’টি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হতে পারে।
জওহরলাল নেহরু
পি সুন্দরাইয়া
এ বার শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকদের মধ্যেও এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক মেরুকরণ দেখছিলাম। হয় আপনি মোদী-বিরোধী। নয়তো মোদীভক্ত। এক পক্ষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় মোদীকে বলছে ‘শয়তান ঘাতক’, অন্য দিকে, আর এক পক্ষ মোদীকে অবতারে পরিণত করেছেন, যেন তিনি রক্ত-মাংসের মানুষই নন। কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছিলাম ১৯৮৭ সালে, তখন বিজেপি-র সাংসদ সংখ্যা দুই। সাংবাদিক হিসাবে বিজেপি-র অফিসে যাওয়া শুরু করেছি। এত বছর ধরে বিজেপি ‘কভার’ করেও নিজেকে বিজেপি-র সমর্থক হতে হয়নি। বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। আডবাণীকে এক বার বলেছিলাম, “আপনার কাজকর্ম সাংবাদিক হিসাবে মূল্যায়ন করেছি, কিন্তু আমাকে যেন কোনও দিন আরএসএস ভাববেন না।” হাসতে হাসতে আডবাণী বলেছিলেন, “কেন, তুমিও কি কলকাতার কমিউনিস্ট?” নরেন্দ্র মোদীকে দেখছি সেই সময় থেকে। নরেন্দ্র মোদী যে ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য তা আর অস্বীকার করা যায় না। গাঁধী পরিবারের মতো কোনও অভিজাত পরিবারের প্রতিনিধি নন মোদী, তিনি এক অতি সাধারণ চা-ওয়ালার পুত্র। মা বাসন মাজতেন। তিনি আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। তা হলে কী ভাবে এটা সম্ভব হল, তার বিচার বিশ্লেষণ করব না। গোধরা কলঙ্কিত বলে তাঁকে যাঁরা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, তাঁদের ভাবতে হবে গোটা দেশের বিপুল জনসমর্থন কী ভাবে নরেন্দ্র মোদী করায়ত্ত করলেন? এটা যদি ভিড়তন্ত্র হয় তা হলেও প্রশ্ন, এই ভিড় কেন? এই লোকটির প্রতি কেন এত মানুষ অনুরক্ত হলেন তারও তো একটা আর্থ-সামাজিক কারণ থাকবে!
ভোটের সময় রাজনৈতিক নেতাদের কথোপকথনে, পারস্পরিক আক্রমণের মধ্যে নাকি অনেক সময় নাটকও থাকে, যাকে বলে ‘নওটঙ্কি’। বিশেষত গ্রামীণ নিম্নবর্গের মানুষ নাকি বিশেষ করে ভোটের সময় অন্ত্যজ ভাষা পছন্দ করেন। গালাগালির তো একটা টিআরপি বা বাজার কাটতি রয়েছে। অনেক রাজনীতিক যেমন আমাকে পাল্টা বলেছেন, সংসদে ভাল বক্তৃতা দিলে আপনারা লেখেন না, মারামারি করলে তা প্রচার পায়। তাই প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে আমরা এত মারামারি করি। টিভি চ্যানেলগুলিতে নিরবচ্ছিন্ন সিরিয়াস আলোচনার চেয়ে রাজনৈতিক নেতাদের তরজার বাজার বেশি। ইংরেজি চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের বিতর্ককে অনেকে নাম দিয়েছে গ্ল্যাডিয়েটর্স।
আসলে আমার বক্তব্য অন্যত্র। সাংবাদিক হিসাবে শুধু নয়, ভারতীয় নাগরিক হিসাবে যে কোনও দল, মতাদর্শ বা ঘটনা সম্পর্কে আমার নিজস্ব বক্তব্য থাকতেই পারে। কিন্তু অন্যকে সেই মতটা মানতে বাধ্য করব কেন? আমার মত অন্য জন মানছে না বলে তাকে ঘৃণা করব কেন? পরমতসহিষ্ণুতা থেকেই কিন্তু দীন-ই-ইলাহির জন্ম। অমর্ত্য সেন তাঁর সত্তা ও হিংসা সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছেন, মানুষের আসলে অনেকগুলি সত্তা থাকে। আবার নানা সত্তা একসঙ্গে বসবাস করে। সত্তা যখন দমননীতি নেয়, অন্যের সত্তার উপর স্টিমরোলার চালাতে চায় সেটা হল হিংসা ও দাঙ্গা। হিংসা লুক্কায়িত হতে পারে। ফেসবুকে কারও মতামতের প্রেক্ষিতে আমার ভিন্ন মত জানালাম না, কিন্তু মনে মনে তাকে গালিগালাজ করলাম, তাও কিন্তু এক ধরনের হিংসা।
নরেন্দ্র মোদী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
উইনস্টন চার্চিল আর ন্যান্সি এস্টারের গল্পটা জানেন? ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তার্কিক ন্যান্সি এস্টার এক বার রেগে গিয়ে বলেন, “আপনি যদি আমার স্বামী হতেন তা হলে আপনার কফিতে আমি বিষ মিশিয়ে দিতাম।” সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে চার্চিল বলেন, “আর আপনি যদি আমার বউ হতেন তা হলে সেই বিষ মেশানো কফি আমি পান করে নিতাম।” এ কথা শুনে সব ভুলে গিয়ে গোটা পার্লামেন্টে হাস্যরোল ওঠে।
বড় টেনশন। ভারতীয় রাজনীতির আবহে বড় স্ট্রেস। বিপ্লব করতে গিয়ে ব্যক্তিহত্যার হিংসা চেয়েছিল মাওবাদীরা। আজ বোধহয় অনেকেই ভাবছেন এই হিংসার পথ ভুল। শ্রেণি সংঘাতের নামে ব্যক্তিগত হিংসা কোনও চলার পথ হতে পারে না। আমাদের মধ্যে আসলে আজ এক ভয়ঙ্কর বনাম-এর সংস্কৃতি কাজ করছে। হয় তুমি ইস্টবেঙ্গল, না হয় মোহনবাগান। হয় তুমি চিংড়ি, নয় তুমি ইলিশ। হয় তুমি সিপিএম, নয় তুমি তৃণমূল। হয় সাদা, নয় কালো। আমরা-ওরা। সাদা-কালোর মধ্যে এক ধূসরতা থাকে। এই ধূসরতাই আসলে সত্য।
বরং আস্থা রাখি ভিন্ন সত্তায়। আমি যা ভাবছি সেটাই ঠিক আর বাকিরা সবাই অর্বাচীন, নিজেকে এতটা পণ্ডিত না হয় না-ই বা ভাবলাম।
যে পাণ্ডিত্য হিংসার জন্ম দেয় তা আমরা চাই না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy